বিশেষ নিবন্ধ : নিঃশব্দঘাতকঃ ধোঁয়াশা – লেখিকা- পৌলমি নাগ হালদার
ধোঁয়াশা
সকাল তখন সাতটা। চারিদিক যেন কুয়াশার চাদরে মোড়া। সকাল সাতটাতেও সুর্যিমামার দেখা নেই। কুয়াশা যেন সূর্যিমামাকে সযত্নে চাদরে মুড়ে ফেলেছে।
কিন্তু এ কুয়াশা সে কুয়াশা নয়, এক ভিন্নতর ধোঁয়াশা। চারিদিকে ধুলোর কুয়াশায় ছেয়ে গেছে। এক ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। বর্তমানে এক বৃহৎ সমস্যার নাম হল দুষণ। প্রতিনিয়ত আমরা শব্দদুষণ, বায়ুদুফল, জল দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ এই শব্দগুলোর সাথে খুব পরিচিত হচ্ছি।
[লেখা পাঠান এই ইমেলে– [email protected]]
সৃষ্টির আদি কাল থেকেই প্রকৃতি, মাতৃস্নেহে তার সন্তানদের অর্থাৎ সমগ্র জীবকুলকে সাদরে লালন পালন করে চলেছে। সন্তানদের সমস্ত চাহিদা পূরণে যেমন একজন মা সদা-ব্যস্ত থাকে, ঠিক তেমনি প্রকৃতি জীবজগততে বিবিধ চাহিদা পূরণে বিমুখ করেনি, করছেওনা। কিন্তু সন্তান বড় হোয়ার সাথে সাথে তার মায়ের আঁচল থেকে বেরিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, তখন তার চাহিদা যেমন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং নিজেকে বিপথে চালিত করে। ঠিক তেমনি জীবজগত তথা মানুষ মাতৃসম প্রকৃতির দানকে ভুলে গিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ফলতঃ এক অসহনীয় প্রতিকূল বাতাবরণে জীবজগতের অবক্ষয় ঘটে চলেছে প্রতিনিয়তই।
[প্রবন্ধ প্রতিযোগীতার সকল লেখা পড়ুন এখানে ক্লিক করে]
হ্যাঁ, বায়ুদূষণ প্রকৃতি ধ্বংসের অন্যতম কারণ। আধুনিক বিলাসবহুল জীবনযাত্রার বহুমূখী সাধ-সাধনে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ বেপরোয়া ব্যবহার ও অরণ্য ধ্বংস করে সবুজায়নকে বিঘ্নিত করছে, ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণের মাত্রা। বায়ুদূষণ সেখানে স্বভাবতঃই জীবনঘাতী, সর্বগ্রাসীরূপ ক্রমশই বিস্তার করে চলেছে। সম্প্রতি বায়ুদূষণে ভারতের রাজধানী দিল্লি সারা বিশ্বে নিকৃষ্টতম নগরী রূপে চিহ্নিত হয়েছে। এই দূষণের দিক থেকে লকাতাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি নানান সমীক্ষার দ্বারা দেখা যাচ্ছে যে সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতবর্ষের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক।
চলতি নভেম্বরে কলকাতা শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষ ব্যক্তিগত যানবাহন ছাড়া ভাবতেই পারে না। তাছাড়াও অত্যাধিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একাধিক সরকারি, বেসরকারি যানবাহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাতাসে বিপুল পরিমানে কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি, যা বাতাসকে কলুষিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তাছাড়া কলকারখানার ধোঁয়া এবং এ.সি., ফ্রিজ, চিমনি থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব শহরে যানবাহন-নিঃসৃত ধোঁয়ার মধ্যে থাকছে প্রচুর পরিমানে হাইড্রেকার্বন। এই হাইড্রোকার্বনের সঙ্গে নাইট্রোজেন অক্সাইড ও ওজোন যুক্ত হয়ে এই মারাত্মক ঘাতক ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে দেওয়ালীর দিন বাজি পোড়ানোর ফলে কলকাতার বহু জায়গায় Air quality খুব খারাপ পর্যায়ে নেমে গিয়েছে।
যদিও গাছপালা যথেষ্ট পরিমানে থাকলে বায়ু দূষণের ফলে বাতাসে ভাসমান অতিসূক্ষ কণাকে শোষণ করে কিছুটা দূষণমুক্ত করতে পারত, কিন্তু সেখানেও সমস্যা সৃষ্টি করছে মানুষ। বহুতল আবাসন নির্মাণের প্রলোভনেন গাছপালা ধ্বংস করে যাচ্ছে নির্বিচারে। ফলে পরিস্থিতি চরম থেকে চরমতম ভাবে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। মানূষের বিভিন্ন ধরনের মারণ রোগব্যাধি যেমন অ্যাজমা, কাশি, ব্রঙ্কাইটিস এর বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উর্ধ্বমুখী হয়ে পড়েছে।
তাই আজ সময় এসেছে, এই প্রাণের স্পন্দনকে যথাযথভাবে বাঁচানোর এবং সুদূরপ্রসারী কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার। যদি আমরা আজও আন্তরিকভাবে সচেতন না হই তাহলে সুদূর ভবিষ্যতে এই সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের ভাবী প্রজন্ম তথা জীববৈচিত্র্যের জন্য আমাদের প্রয়োজন আত্মসমীক্ষার, জনজাগরণের তথা সচেতনমূখী কার্যধারার।
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় আমাদের আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে-
‘এই বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’
© লেখিকা- পৌলমি নাগ হালদার, মেদিনীপুর শহর,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা।
প্রকাশনায়- www.studentscaring.com