শকুন্তলা রেলওয়ে : ভারতের এই রেলপথটি এখনও ব্রিটেনের অধীনে!

পোস্টটি শেয়ার করুন
5/5 - (1 vote)

ভারতের এই অংশ এখনও ব্রিটেনের দখলে! দিতে হয় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব! শকুন্তলা রেলওয়ে

পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রেল নেটওয়াক হল ভারতীয় রেল। ভারতের প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যা প্রত্যক্ষ ও অপ্রতক্ষ ভাবে কোনো না কোনো ভাবেই রেলের ওপর নির্ভরশীল। দেশের বৃহত্তম কর্মসংস্থানের মাধ্যম হল ভারতীয় রেল। আসমুদ্রহিমাচল সর্বত্রই ভারতীয় রেল তাদের পরিষেবা প্রদান করে থাকে। বর্তমানে ভারতীয় রেলের ১৭টি আঞ্চলিক বিভাগ রয়েছে বৃহত্তর এই পরিষেবা প্রদানের সাপেক্ষে দেশের অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে ভারতীয় রেলকে জাতীয় জীবনরেখা বলা হয়ে থাকে। ভারতীয় রেলের সম্পর্কে নানান অজানা তথ্য হয়ত আপনাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না। যদি জানেন ভারতীয় হিসাবে আপনার গর্ববোধ হবেই। জেনে নিন এখানে ক্লিক করে। আমরা সকলেই জানি ১৬ এপ্রিল ১৮৫৩ সালে ভারতে প্রথম রেল চলাচল শুরু হয়। তারপর থেকে ক্রমাগত আমরা রেলের প্রতি নির্ভরর্শীল হয়ে পড়েছি। বর্তমান দিনে রেল আমাদের কাছে জীবনরেখা হিসাবে পরিচিত। এমনকি আমরা হয়ত আর কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্রুততম রেল ‘বুলেট ট্রেন’ চলাচলের সাক্ষী হয়ে থাকব। কিন্তু আমাদের অনেকের জানার বাইরে আরও একটি অজানা বিষয় রয়েছে যেটা আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত জানিনা। আমরা জানিনা ভারতীয় রেলের এমন একটি অংশ রয়েছে যেটা কিনা ভারতীয় রেলের অধীনে নেই ( শকুন্তলা রেলওয়ে )। তাহলে কার অধীনে রয়েছে? কি বলতে চাইছি আমি? এমন কি কোনো রেল বা রেলপথ রয়েছে যেটা অন্য কোনো দেশ বা অন্য কোনো কোম্পানির অধীনে রয়েছে? এটাই আজ আপনাদের জানাবো।

প্রথমে আপনাদের বলে রাখি, আজ আমরা আপনাদের এমন একটি রেললাইনের সম্পর্কে বলতে যাচ্ছি যার মালিকানা ভারতীয় রেলওয়ের কাছে নেই। ব্রিটেনের একটি প্রাইভেট কোম্পানি এটি পরিচালনা করে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার আগে আপনি বরং ভারতীয় রেলের সমগ্র ইতিহাস গুলি জেনে নিন আমাদের আগের একটি পোস্ট থেকে। ভারতীয় রেলের ইতিহাস জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

শকুন্তলা এক্সপ্রেস। ট্রেনটি চলাচল করে মহারাষ্ট্রের অমরাবতী মহকুমায় অচলপুর থেকে ইয়াভাতমাল পর্যন্ত চলে।

Shakuntala Express
চিত্রে ইয়াবতমাল স্টেশন দেখছেন

এটি একটি নেরো গেজ লাইন (২ ফুট ৬ ইঞ্চ বা ৭৬২ মিমি)।  অচলপুর থেকে ইয়াভাতমাল এই লাইনটিকে মুর্তাজপুর জংশন দুটি ভাগে ভাগ করেছে। মুর্তাজপুর থেকে উত্তরের অংশটি অচলপুর পর্যন্ত ৭৬কিমি বিস্তৃত ( পথটি অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘন্টা) এবং দক্ষিনের অংশটি ১১৩ কিমি বিস্তৃত। মোট যাত্রাপথ প্রায় ১৮৯ কিমি অতিক্রম করতে প্রায় ২০ ঘন্টা সময় লাগে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুর্তাজপুর জাংশন এই নেরোগেজ লাইনটিকে হাওড়া-নাগপুর-মুম্বাই ব্রড গেজ লাইনের সাথে যুক্ত করেছে। এই যাত্রায় শকুন্তলা এক্সপ্রেস অচলপুর, ইয়াভাতমাল সহ ১৭ টি ছোট ও বড় স্টেশনে দাঁড়ায়।

Join us on Telegram

♦ শকুন্তলা রেলওয়ের শুরুর কথা-

শকুন্তলা এক্সপ্রেস চলার কারণে এই রুটটি অর্থাৎ অচলপুর থেকে ইয়াভাতমাল পর্যন্ত রুটটি ‘শকুন্তলা রেল রুট’ নামেও পরিচিত। 1903 সালে, ‘কিলিক অ্যান্ড নিক্সন’ নামের এক ব্রিটিশ সংস্থা এর নির্মান শুরু করে এবং এই রেলওয়ে ট্র্যাকের নির্মাণ কাজ 1916 সালে সম্পন্ন হয়েছিল। আপনাদের জানিয়ে রাখি, এই ক্লিক, নিক্সন ও কোম্পানিটি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। বর্তমানে “কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক রেলওয়ে কোম্পানি বা Central Provinces Railway Company (CPRC) ” নামে পরিচিত। বর্তমানে এটাই ভারতের একমাত্র বেসরকারি রেলপথ।

♦ শকুন্তলা রেল চালানোর উদ্দেশ্যঃ

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ভারতে তাদের আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। তারা কিভাবে ভারত থেকে পণ্য সামগ্রী ব্রিটেনে রপ্তানি করা যায় সেই উপায় খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমরা সকলেই জানি দাক্ষিনাত্যের কৃষ্ণ মৃত্তিকা অঞ্চলে কার্পাস চাষের পক্ষে উপযুক্ত স্থান। এবং ভারতের সর্বোচ্চ কার্পাস চাষ হয় এই অঞ্চলেই। ব্রিটিশরা এর সুযোগ নিতে চেয়েছিলো, তারা সিদ্ধান্ত নিল অচলপুর-মুর্তাজপুর- ইয়াভাতমাল রুটের মাধ্যমে, বিদর্ভ থেকে মুর্তাপুর পর্যন্ত ২ ফুট ৬ ইঞ্চি ন্যারো গেজ রেল পথের মাধ্যমে কার্পাস এনে তারপর মুর্তাজপুর থেকে ব্রড গেজ পথের মাধ্যমে সেই কার্পাস মুম্বাই পর্যন্ত পাঠানো হবে। অবশেষে মুম্বাই থেকে সমুদ্রপথে ব্রিটেনের ‘ম্যাঞ্চেস্টারে’ কার্পাস রপ্তানি করা হবে। এটাই ছিল এই রেল পথ স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য। যদিও বা এই রেল পথের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার স্থানীয় মানুষরা খুবই উপকৃত হতেন এবং আজও উপকৃত হচ্ছে।

শকুন্তলা এক্সপ্রেস
শকুন্তলা এক্সপ্রেসের পুরানো বাষ্পচালিত ইঞ্জিন

♦ শকুন্তলা রেলওয়েটি এখনও ব্রিটিশদের মালিকানাধীন কেন?

ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। স্বাধীন হওয়ার ঠিক ৪বছরের মধ্যে ১৯৫১ সালে ভারতীয় রেলওয়ে জাতীয়করণ করা হয়েছে। শুধু বাকি থেকে গেল একটাই রেলপথ,- শকুন্তলা রেলওয়ে। অচলপুর থেকে মুর্তাজপুর পর্যন্ত লাইনটি মুর্তাজপুর বিভাগে থাকলেও, ইয়াভাতমাল থেকে মুর্তাজপুর পর্যন্ত ১১৩ কিমি বিস্তৃত লাইনটি মালিকানা রয়েছে CPRC-র অধীনে। যেকোনো কারনের হোক এই অংশটিকে সেই সময় জাতীয়করন করা হয়নি (কারও কারও মতে এটি তৎকালীন ভারত সরকারের উদাসীনতার ফলাফল)।

শকুন্তলা রেলওয়ে
চিত্রে মুর্তাজপুর থেকে দুই দিকে শকুন্তলা এক্সপ্রেসের যাত্রা পথ দেখানো হয়েছে

অর্থাৎ শকুন্তলা রেলওয়ে এখনো ব্রিটিশ কোম্পানির মালিকানায় রয়েছে। ব্রিটেনের একটি প্রাইভেট কোম্পানি এটি পরিচালনা করে। এই রেলরুটের জন্য ভারত সরকার প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব দেয় ব্রিটিশ সরকারকে। আজও এই ট্র্যাক ব্রিটিশ কোম্পানীর মালিকানাধীন রক্ষণাবেক্ষণের পূর্ণ দায়িত্ব তাদের ওপর রয়েছে। প্রতি বছর টাকা দেওয়ার পরেও ট্র্যাকটি খুব জীর্ণ অবস্হায় রয়েছে। রেলওয়ে সূত্র অনুযায়ী, গত ৬০ বছরে এটি মেরামত করা হয়নি।

♦ শকুন্তলা রেলওয়ের সিগন্যাল সিস্টেম এবং রেল ইঞ্জিন-

শকুন্তলা রেলওয়ের A ZD বাষ্পচালিত ইঞ্জিনটি তৈরি হয়েছে ১৯২১ সালে ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টারে। এটি ১৯২৩ সালে যাত্রা শুরু করে। এরপর মহারাষ্ট্রের আচলপুরের নিসর্গকে দুদিকে রেখে এখনও রোজ ছুটে চলেছে শকুন্তলা। শুধু মাঝে ৭০বছরের ক্লান্তিকে ১৫ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে ধুয়ে ফেলা হয়েছে, যেদিন থেকে এসেছে ডিজেল ইঞ্জিন।

ডিজেল চালিত ইঞ্জিন
ডিজেল চালিত ইঞ্জিন

বাষ্প চালিত ইঞ্জিনটি এখন পুনের এক সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। ইঞ্জিনটিকে ডিজেল ইঞ্জিনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করার কারণ হিসাবে রেলের অ্যাসিস্টেন্ট ড্রাইভার ‘হাসান খান’ এর মতে,

“ওই অঞ্চলের জলের অপচয় রোধ করার জন্যই এইরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে”।

জেডিএম সিরিজের এই ডিজেলে চলমান ইঞ্জিনের সর্বাধিক গতি প্রতি ঘন্টায় ২০ কিলোমিটারে রাখা হয়।

এই রেলপথের সিগন্যাল এখনও ব্রিটিশ সময়ের। সিগন্যাল সিস্টেম ১৮৯৫ সালে ব্রিটেনের লিভারপুরের এক কোম্পানিতে নির্মান করা হয়েছিল। প্রমাণ হিসাবে, প্রতিটা রেল সিগন্যালের গায়ের লেখাগুলোয় আজও জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা শব্দ – ‘মেড ইন লিভারপুল’

Vitage-GIPR-plaque

♦ স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর শকুন্তলা রেলওয়ের গুরুত্ব-

মহারাষ্ট্রের ইয়াবতমল থেকে মুর্তিজাপুর জংশন পর্যন্ত এখন নিয়মিত যাতায়াত করে শকুন্তলা এক্সপ্রেস। ওই অঞ্চলের কয়েকশো মানুষের দৈনিক যাতায়াতের একটাই উপায়- শকুন্তলা এক্সপ্রেস। সড়ক পথের খরচ বইতে না পারা মানুষগুলোর জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে নামটা। ৭ কোচের এই যাত্রীবাহী ট্রেনে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি লোক যাত্রা করে।

এই ট্র্যাকে চলমান শকুন্তলা এক্সপ্রেস প্রথমবার ২০১৪ সালে এবং দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে বন্ধ করা হয়। স্থানীয় জনগণের চাপে এবং আনন্দ রাও-এর চাপে সরকার আবার এটি চালু করতে বাধ্য হয়। এমপি আনন্দ রাও বলেছেন,

“এই ট্রেনটি হল অমরাবতী জনগণের লাইফলাইন। দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি এটি বন্ধ হয় গরীব জনগণের অনেক সমস্যা হবে”।

ভারত সরকার এই ট্র্যাকটি বেশ কয়েকবার কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কয়েকটি কারণের জন্য এটা সম্ভব হয়নি।

♦ শকুন্তলা রেলওয়ের ভবিষ্যৎ-

২০১৬ সালে ভারতীয় রেল ঘোষণা করেছে এই রেল পথকে নেরো গেজ থেকে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি (১,৬৭৬ মিমি) ব্রড গেজ লাইনে রূপান্তরিত করা হবে। এর জন্য ১৫০০ কোটি টাকা ধার্য করেছে কেন্দ্র। তাই খুব শিগগির হয়তো নতুন চেহারায় সাজবে শকুন্তলা রেলওয়ে।

♦ ইন্ডিয়া টিভির একটি প্রতিবেদন (২০১১) দেখুন-

♦ এক নজরে শকুন্তলা রেলওয়ের কিছু তথ্য

  • শকুন্তলা রেলওয়েটি হল ভারতের একমাত্র বেসরকারি রেল কোম্পানি, যেটি এখনো সক্রিয় রয়েছে।
  • ট্রেনটি চলাচল করে মহারাষ্ট্রের অমরাবতী মহকুমায় অচলপুর থেকে ইয়াভাতমাল পর্যন্ত চলে।
  • 1903 সালে, ‘কিলিক অ্যান্ড নিক্সন’ নামের এক ব্রিটিশ সংস্থা এর নির্মান শুরু ক…
  • শকুন্তলা রেলওয়ে টি এখনও ব্রিটিশদের মালিকানাধীন।
  • শকুন্তলা রেলওয়ে মূলত কার্পাস রপ্তানির উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিলো, যেটি পরবর্তী কালে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হয়ে দাঁড়ায়।
  • শকুন্তলা রেলওয়ে র জন্য ভারত সরকার প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব দেয় ব্রিটিশ সরকারকে।
  • শকুন্তলা রেলওয়ে র A ZD বাষ্পচালিত ইঞ্জিনটি তৈরি হয়েছে ১৯২১ সালে ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টারে।
  • অমরাবতি অঞ্চলের মানুষদের কাছে এই পথটি জীবনরেখা হিসাবে পরিচিত, সবচেয়ে সস্তা এবং উপযোগী।
  • মুর্তাজপুর জাংশন এই নেরোগেজ লাইনটিকে হাওড়া-নাগপুর-মুম্বাই ব্রড গেজ লাইনের সাথে যুক্ত করেছে।
  • ২০১৬ সালে ভারতীয় রেল ঘোষণা করেছে এই রেল পথকে নেরো গেজ থেকে ব্রড গেজে রূপান্তরিত করা হবে।

ধন্যবাদ আপনাকে স্টুডেন্টস কেয়ারের সাথে থাকার জন্য। লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন। এবং পরবর্তী পোস্ট পড়ার আগাম আমন্ত্রন রইল। আমাদের ফেসবুকে যুক্ত হন।

Students Care

স্টুডেন্টস কেয়ারে সকলকে স্বাগতম! বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার সমস্ত খবরা-খবরের একটি অনলাইন পোর্টাল "স্টুডেন্ট কেয়ার"। পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সমস্ত চাকুরী প্রার্থীদের জন্য, এছাড়াও সকল জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গদের সুবিধার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।  

error: স্টুডেন্টস কেয়ার কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত !!