বিশেষ নিবন্ধ : বায়ু-দূষণে আক্রান্ত জনজীবন – লেখকঃ- হরিশ চন্দ্র কুর্মি
ভারতবর্ষে বায়ুদূষণে প্রথম দশটি শহরের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে রাজধানী দিল্লি। বারাণসী, নয়ডা, গাজিয়াবাদ, আগ্রা প্রভৃতি শহরগুলি যেন দূষণ তালিকায় ওপরের দিকে থাকার প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। এই শহরগুলির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) অনুযায়ী মান
[লেখা পাঠান এই ইমেলে– [email protected]]
৪৫০-৫০০ এর মধ্যে। অথচ শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে এই মান ১০০ এর বেশি হওয়া উচিত নয়। দিল্লিতে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন সকালে দৃশ্যমানতা কখনও কখনও ৪০ মিটারে নেমে আসে। তখন ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। বহু ট্রেন অত্যন্ত দেরীতে চলে, অনেক ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়, উত্তর ভারতের বহু অংশে ট্রেনের যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে হয়। বায়ুর ভয়াবহ দূষণের জন্য স্কুল বন্ধ রাখতে হয়, যাতে ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে বেরােতে না পারে। বাতাসে ভাসমান বিশেষ কণিকাগুলি ঘনবদ্ধ হয়ে টক্সিক মাত্রায় পৌঁছে যায়। শ্বাসকষ্ট হয়, এর ফলে ছােটরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
[প্রবন্ধ প্রতিযোগীতার সকল লেখা পড়ুন এখানে ক্লিক করে]
শীতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যানবাহন চলাচলের বিশেষ সূচির প্রবর্তন করতে হয়েছে দিল্লির সরকারকে। গাড়ির নম্বরের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে ‘জোড়’ ও ‘বিজোড়’ নম্বরের ফর্মুলা। একদিন জোড় নম্বরের গাড়িগুলি পথে নামবে, অন্যদিন বিজোড় নম্বরের গাড়িগুলি সেই সুযােগ পাবে। অবশ্য দু’চাকার গাড়িগুলিকে এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়েছে। এই সূচি প্রবর্তন করেও দূষণের মাত্রায় বিশেষ হেরফের ঘটানাে সম্ভব হয়নি। তাই ভাবা হয়েছে ডিজেল চালিত গাড়িগুলি পনেরো বছরের পুরানাে হলে চালানাের অনুমতি দেওয়া হবে না। ডিজেল চালিত গাড়িগুলি থেকে যে কালাে ধোঁয়া নির্গত হয়, তাতে বায়ু দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। মাঠে পরিত্যক্ত ফসলের অংশ পােড়ায় পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাব হরিয়াণার কৃষকেরা, বায়ু দূষণের সেটাও অন্যতম বড়ো কারণ। দেওয়ালির সময় বাজি পােড়ানাে হয়, তাতেও দূষণ বেড়ে যায় বলে দিল্লির সরকার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রতি বছর। সেই নির্দেশকে অমান্য করে বাজি পােড়ানাের উৎসবে অংশগ্রহণে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ। যে দূষণ জীবনকে বিপন্ন করে, শাসকষ্টজনিত রােগে আক্রান্ত হয় মানুষ, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রয়াসে যদি গাফিলতি থাকে, তবে মানুষকেই ভুগতে হয়। কোনো আইনের সাহায্যে দূষণকে কিছুতেই প্রতিরােধ করতে পারবে না সরকার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। মানুষের সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক কালে দিল্লিতে দূষণের শিকার হয়েছিলেন ভারত ও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট খেলােয়াড়রা। ফিরােজ শাহ কোটলাতে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচে দেখা গেছে খেলােয়াড়রা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য ঠিকমতাে খেলতে পারছিলেন না। একদিন তাে কুড়ি মিনিট খেলা বন্ধ রাখতেও হয়েছিল। খেলাটি পরিত্যক্ত ঘােষণা না হলেও, অবশ্য আলােচনা হয়েছিল — দূষণের মাত্রা কী পরিমাণ থাকলে খেলােয়াড়দের পক্ষে খেলতে কোনাে অসুবিধা হবে না। সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি, যদিও দূষণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার মনােভাব প্রকাশ পেয়েছে।
দূষণের সমস্যা নিয়ে বিব্রত সারা পৃথিবী। বায়ুদূষণের সৃষ্টি হয়েছে মূলত গ্রিন হাউস গ্যাস বাতাসে ছাড়ার জন্য। জলবায়ু দুষিত করার জন্য ও উত্তাপ বাড়ানাের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলি। গ্রিন হাউস গ্যাস বাতাসে ছড়াতে প্রথম স্থান দখল করে আছে আমেরিকা ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন। চীনে বায়দুষণ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে বেজিং এর আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তাই বেজিং অলিম্পিকের আগে সেই ধোঁয়ার আস্তরণ আকাশ থেকে সরাতে চিন সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল। বেজিং এর আশেপাশে যত বড় বড় কারখানা ছিল সেগুলি বন্ধ করে অন্যত্র সরিয়ে দিতে হয়েছিল।
জলবায়ুর পরিবর্তন রােধ করতে ও দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘লাে কার্বন’ নীতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। কয়েক বছর আগে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ১৯২ দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে জলবায়ু বিষয়ে এক আলােচনা চক্রে এই কথা বলেছিলেন ভারতের প্রতিনিধি জয়রাম। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালের মধ্যে আমরা ২০-২৫ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ কমাবো। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ভারত কতটা সফল হয়েছে, তা অবশ্য এই মুহুর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ তাদের ভূমিকা পালনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ভারতে অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে কয়লা ব্যবহার করা হয়। তার ফলে কোল অ্যাশ ও কেন্দ্র থেকে নির্গত ধোঁয়ায় যে কার্বন থাকে, তাতে বায়ু দূষণের পরিমাণ বাড়ে। সেই কারণে অচিরাচরিত প্রথায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চলছে। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া ও জাপানে পরমাণুবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার ফলে জনজীবনের নিরাপত্তা যেমন বিপন্ন হয়ে পড়েছে, তেমনি বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব অনেক বেশি দূষণের সৃষ্টি করেছে। তাই পরমাণুবিদ্যুৎ নির্মাণ কেন্দ্র ঘিরে আতঙ্কিত মানুষের বিক্ষোভ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া তৈল শােধনাগারও দূষণের সৃষ্টি করে। সেই দূষণে আক্রান্ত হয়েছে আগ্রার তাজমহল। সাদা মার্বেল পাথরের গায়ে হলদে-কালচে দাগ সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার যে উপায় অবলম্বন করা হয়েছে, তাতেও দূষণ কমানাে সম্ভব হয়নি। তৈল শােধনাগার বন্ধ করে দিলে দূষণের মাত্রা কমবে, কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়তাে সম্ভব হবে না।
শহর কলকাতাও দূষণে আক্রান্ত। শীতকালে শীতের দেখা নেই। এজন্য শুধু নিম্নচাপ, ঘূর্ণাবর্ত ও দুর্বল উত্তরের হাওয়াকে দোষী সাব্যস্ত করতে চান না পরিবেশবিদরা, তাদের মতে মাত্রাছাড়া বায়ুদূষণের জন্য শহরের উষ্ণতার পারদ নামতে বাধা পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে দূষণের মাত্রা কম থাকায় সেখানে শীতের অনুভূতি ভালোভাবে হচ্ছে। ভােরের দিকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় যে প্রবল ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে তার জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। তারা অভিযােগ করেছেন, ডিজেলচালিত গাড়ির ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধূলােই দূষণ বাড়াচ্ছে। এক পরিবেশ বিজ্ঞানী বলেছেন, বাতাসে কার্বন কণা ও ধূলাের জন্য মাটি থেকে তাপ পুরােপুরি বিকিরিত হতে পারছে না। কার্বন কণার তাপশােষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তা তাপ শুষে নিচ্ছে। ফলে বাতাসে গরম ভাব থাকছে। একেই ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’ বলেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত মিদ্যা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ রায়চৌধুরীও বলেছেন, বায়ুতে বাড়তি কার্বনের ফলে গােটা বিশ্ব উষ্ণ হয়ে উঠছে। কলকাতার ক্ষেত্রেও সেই ঘটনা ঘটছে। এটা চলতে থাকলে জলবায়ু বদলে যাবে দ্রুত। রােদ উঠলে কুয়াশা কেটে যেতে শুরু করে, কিন্তু ইদানীং শহরে যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, তা সহজে কাটছে না। এই কুয়াশার রং ঠিক সাদা নয়, কালচে রঙের। কার্বন ও ধূলিকণা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে তাকে গাঢ় করে তুলছে। ক্রমাগত তাপ শুষতে থাকায় রােদ উঠলেও জমাট বাধা জলীয় বাষ্প সহজে কাটছে না। দূষণ ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে জনজীবনকে।
দূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে রাষ্ট্রসংঘ সম্প্রতি এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, দিল্লি ও অন্যান্য বড় শহরগুলি নতুন ধরনের বিষাক্ত ধোঁয়াশায় ভরে গেছে, তার প্রভাবে সৃষ্ট দূষণ যে ক্ষতি করছে তা হল শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা। রাষ্ট্রসংঘের শিশুদের বিভাগ ইউনিসেফ জানিয়েছে পৃথিবীর ১ কোটি ৭০ লক্ষ এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এশিয়াতে রয়েছে ১ কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি শিশু যারা সাংঘাতিকদূষণে আক্রান্ত অঞ্চলে বাস করে। এই দূষণ নিরাপদে থাকার মাত্রা থেকে ৬ গুণ বেশি।
শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা দেশগুলির তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত। তারপরেই রয়েছে চীন। ইউনিসেফের এক রিপাের্টে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করতে উপগ্রহ মারফত গৃহীত চিত্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তা থেকে জানা গেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে দূষণে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা ১ কোটি ২২ লক্ষ। আফ্রিকার শহরগুলিতে এই সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুদূষণে যেসব রােগের সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ও শ্বাসকষ্ট জনিত অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রােগ।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যে সত্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হল বায়ুদূষণ শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে এক ঝুঁকিপূর্ণ পথে টেনে নিয়ে চলেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের বিকাশমান মস্তিষ্ক।
রিপাের্টের উল্লেখযােগ্য অংশ হল, দুষণের সঙ্গে মস্তিষ্কের কর্মশক্তির প্রত্যক্ষ যােগাযােগ রয়েছে। বিশেষ করে ভার্বাল ও নন ভার্বাল আইকিউ, স্মরণশক্তি ক্রমশ নিম্নগামী হয়ে পড়ছে। স্কুলে পাঠরত শিশুরা গড় পরিমাপের থেকে কম মার্কস পাচ্ছে, গ্রেড পয়েন্টও কমে যাচ্ছে। তাছাড়াও স্নায়ুসংক্রান্ত রােগের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। যেহেতু পৃথিবীর আরাে বেশি বেশি জনবসতি শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই, তাই আগামী বছরগুলিতে শিশুদের জীবন আরাে বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। শহরের দূষণে ক্ষতিকারক সূক্ষ্ম কণার প্রাধান্য মস্তিষ্কের সঙ্গে রক্তকে পৃথক করে রাখার প্রক্রিয়ার ক্ষতি করতে পারে – এটি অত্যন্ত কোমল আবরণী চামড়া যা বিষাক্ত কণা থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করে।
এই চামড়ার ক্ষতি থেকেই বয়স্ক মানুষের শরীরে জন্ম নেয় আলজাইমার্স ও পারকিনসন রোগের। ইউনিসেফ আরাে একটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, লৌহের চুম্বকশক্তি থেকে উদ্ভুত অতি সূক্ষ্ম কণা শহরের দূষণে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে। এই কণা অত্যন্ত সহজে রক্তের প্রবাহে প্রবেশ করতে পারে। এটা মস্তিষ্কের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর যেহেতু এতে রয়েছে চুম্বকশক্তি। তাছাড়া দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকা অজানা রােগের সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বিষাক্ত অণু প্রভাবিত দূষণ শিশুদের শেখার আগ্রহে বিরূপ প্রভাব ফেলে তাদের স্মরণশক্তি, ভাষাকে আয়ত্ত করার ক্ষমতাকে ও গতিময়তার যােগ্যতাকে নষ্ট করে দেয়। শিশুরা যদি সুস্থ জীবন যাপন করতে সক্ষম না হয়, দুষণে আক্রান্ত হয়ে যদি দুরারােগ্য ব্যাধিতে ভোগে তাহলে সমাজ ও সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশের পথে বিপর্যয় অবধারিত হয়ে উঠবে। তাই দূষণ রােধে ব্যাপক প্রতিরােধ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরী।
দিল্লির বাতাস দূষণমুক্ত করার প্রয়াসের প্রথম পর্বের সূচনা হয়েছিল দু – দশক আগে। সুপ্রিম কাের্ট সরকারকে ও গাড়ি নির্মাণ শিল্পকে বাধ্য করেছিল জ্বালানি ব্যবহার ও ধোঁয়া নির্গমনের নতুন মানদণ্ড প্রয়ােগ করতে। কিন্তু কমপ্রেসড্ ন্যাচারাল গ্যাস সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করা যাত্রীবহনকারী বাস ও অটোরিকশার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে নাসা উপগ্রহের ম্যাপে দেখা গেল শস্য পােড়ানাের স্থানগুলিতে অসংখ্য লাল রঙের ছােট ছােট গােল দাগ। তাই প্রচার মাধ্যমগুলির মনােযােগ চলে গিয়েছিল শহর ছেড়ে গ্রামীণ অঞ্চলগুলির দিকে। উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিবর্তে সমস্যার কারণ নির্ধারণে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিনের বিবর্ণ অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেলেও মানুষের দুর্দশা নিয়ে সচেতনতার অভাব ছিল, দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে অভ্যন্তরীণ মতবিরােধের অবসান ঘটাতে অত্যন্ত সামান্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। দিল্লিকে দূষণের গ্রাস থেকে বাঁচাতে সুবিধাভােগী অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষদের কোনাে ভূমিকা পালন করতে হয় না, অথচ কৃষকদের সরকারি নীতিকে মেনে খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়, ভূগর্ভস্থ জলের সংরক্ষণের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। আরাে একটি অদ্ভুত ব্যাপার, দিল্লির পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য বারেবারে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ প্রয়ােজন হয়েছে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ ভূমিকাই থাকে না। দিল্লির জন্য প্রয়ােজন আমূল পরিবর্তনের নীতি – প্রয়ােজন আরাে বেশি যানবাহন বিহীন অঞ্চলের, বেসরকারি যান বিক্রির ক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি করা, বেআইনিভাবে গাড়ি রাখলে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ, গাড়ি কিনতে হলে গ্যারেজ থাকা বাধ্যতামূলক।
বায়ু দূষণের জন্য শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে এমন রােগীর মৃত্যু ৪০ শতাংশ বেড়েছিল। ২০১৭ সালের মৃত্যুর সংখ্যা জানা না গেলেও পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক। নববর্ষের প্রথম দিনেই দিল্লির বায়ুদূষণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। কলকাতাও পিছিয়ে নেই। সূচক ৩০o পেরােলেই বায়ুদূষণের মাত্রা বিপজ্জনক হিসেবেই গ্রাহ্য হয়। সরকারের যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়ােজন। বাতাসের গুণগত মানের উন্নতি ঘটাতে সব অবৈজ্ঞানিক উন্নয়ন প্রকল্প ও নির্মাণ কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে হবে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে। কলকাতার বাতাসের গড় অবস্থা দিল্লির তুলনায় ভালাে, কিন্তু চেন্নাই ও মুম্বাইয়ের থেকে খারাপ। অবশ্য যেভাবে বায়ুদূষণ বাড়ছে, তাতে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দিল্লির মতাে অবস্থা হতে বেশি সময় লাগবে না। কলকাতায় বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান ধূলিকণা। সেটা দূর করতেই জলকামান ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। বছর দুই আগে চিনে বাতাসের দূষণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে এই জলকামান ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। দিল্লিতেও জলকামান ব্যবহার করা হয়েছে। যেভাবেই হােক দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিতে হবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে। প্রয়ােজন দূষণমুক্ত সবুজ, সুন্দর পরিবেশের।
লেখকঃ- হরিশ চন্দ্র কুর্মি (উত্তর চিরাইল পাড়া, উত্তর দিনাজপুর)
[লেখক ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র]
তথ্যসূত্রঃ- https://
© মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, ভূগোলিকা-Bhugolika, Geography & Environment, স্টুডেন্টস কেয়ার