বিশেষ নিবন্ধ : ময়নার মাছচাষের অন্তরালে – চিন্ময় বিশ্বাস

পোস্টটি শেয়ার করুন
Rate this post

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ময়না ব্লক। রামচন্দ্রপুর, ব্রজবল্লভপুর, রাধাবল্লভচক, প্রজাবাড়, খেজুরতলা আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে তৈরি হয়েছে এই এলাকাটি। বছর কয়েক পূর্বেও আধুনিক সভ্যতা থেকে বেশ কয়েক কদম দূরে ছিল অঞ্চলটি। চাষবাস ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। অঞ্চলটির গঠন সরার মত হওয়ায় প্রায় প্রতি বছরই ক্ষিরাই নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে যেত। ফসল নষ্ট হত। এক দু-মাস ব্যাপক দুর্দশা পোহাতে হত মানুষকে। জল নামত, আবার সব ভুলে মানুষ ব্যান (ধানের চারা) ভাঙত, চারা রুইত, ধান কেটে ঘরে তুলত। পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যতম শিক্ষিত এলাকা ময়না হলেও প্রায় ৮০% পরিবার কৃষির সাথে যুক্ত ছিল। সময়ের সাথে যুগের হাওয়া বদলাতে থাকল। নিচু এলাকা হওয়ায় মাছ চাষ প্রসার লাভ করল ধীরে ধীরে। যাকে স্থানীয় লোকেরা বলে ঝিল ব্যবসা। বছর দশেক পূর্বেও যেখানে বিঘার পর বিঘা জমিতে বছরে ২-৩ বার ধান ফলত এখন সেখানে একখণ্ড ধানি জমি দেখতে হলে আপনাকে গুগল ম্যাপে খুঁঁজতে হবে।

https://t.me/scareofficial

এবার আসি এই ঝিল ব্যবসা কি? ১০-৫০ বিঘা বা তার চেয়েও বড় জমিকে ৩-৪ ফুট গভীর করে চারিদিকে পাড় তৈরি করে ঝিল বানানো হয়। এত বড়ো পুকুর কাটতে সময় তো লাগবে অনেক। আজ্ঞে না। ২০-৩০ দিনে তৈরি হয়ে যায় প্রকান্ড এক ঝিল। ও ভগবান! এ যেন যন্ত্র মানুষ মিলে চলে প্রকৃতির সাথে লড়াই। রাত দিন চলে কর্মকাণ্ড। দেখতে দেখতে ফিকে হয়ে যায় সবুজ।

[লেখা পাঠান এই ইমেলে– [email protected]]

Join us on Telegram

ঝিল তো তৈরি হল। এবার আসে জল চুরি। পুকুর চুরি তো শুনেছেন কিন্তু জল চুরি? আজ্ঞে হ্যাঁ। এত টাকা খরচ করে ঝিল তৈরি করে কি চাতক পাখির মত বৃষ্টির জন্য হা করে থাকবে নাকি? ওই যে আছে ক্ষিরাই নদী। বড়ো বড়ো ইঞ্জিন গুলো লাইন দিয়ে শুষে নিতে থাকে নদীর জল। হায়রে বোকা নদী। দেখতে দেখতে ফ্যাকাসে হয়ে যায় নদীর বুক। কে বলবে বর্ষাকালেও এই নদীতে বান আসে? তারপর? রাতের অন্ধকারে মাটির বুক চিরে চলে জল তোলা। সাবমার্সিবল পাম্প থেকে চলে অবাধে জল তোলা। গরমকাল শুরু না হতেই ময়নার নলকূপ গুলি সব মুখ থুবড়ে পড়ে৷ হদিস মেলে না জলের৷ অনেক আগে থেকেই ময়নাকে ‘ব্ল্যাক জোন’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ মানুষ ভাবে সেটা আবার কি? অবাধে চলে জল চুরি।

[প্রবন্ধ প্রতিযোগীতার সকল লেখা পড়ুন এখানে ক্লিক করে]

কারা তৈরি করে এই ঝিল? বিভিন্ন সমবায় সমিতি, স্থানীয় ব্যবসায়ী, এমনকি অনেক নেতাও টাকা ঢালেন এই ব্যবসায়। কৃষকের জমি নেওয়া হয় লিজের মাধ্যমে। প্রতি কাঠা জমিতে বছরে ৩-৪ হাজার টাকা দেওয়া হয় জমির মালিককে৷ ৫০% এর বেশি জমির মালিক ঝিলের জন্য জমি দিতে চাইলে বাকিদেরও দিতে হয় বাধ্য হয়ে। ধান চাষে এখন লাভ নাই, ঘরে বসে টাকা পেয়ে যাচ্ছ ভাই, আর কি চাই?

এবার শুরু হয় মাছ চাষ৷ লরিতে ভর্তি হয়ে আসে মাছ পোনা৷ শয়ে শয়ে বস্তা ঢালা হয় কৃত্রিম মাছের খাবার৷ লাইন দিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় বস্তা বোঝাই মোটরভ্যান। দ্রুত বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োগ করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক। রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প প্রভৃতি কার্প জাতীয় মাছের চাষ চলে বছরে ৩-৪ বার।

লরি ভর্তি হয়ে মাছ চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রচার হয়, মাছ চাষে রোল মডেল এখন ‘ময়না’।

তবে সবকিছুর অন্তরালে একটা প্রশ্ন কেমন যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যদি কোনদিন এই ঝিল ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়? মানুষ কি ফিরে পাবে তার জমি? নোনা জল আর রাসায়নিকে চড়া পড়ে যাওয়া বন্ধ্যা জমিতে আর কি কোনদিন ধান জন্মাবে? ভূগর্ভ শূন্য করে দেওয়ায় যদি কোনদিন সেঁকোবিষ (আর্সেনিক) বিষিয়ে দেয় হাজার মানুষের শরীর? কে দেবে তার উত্তর? হয়তো বছর কতক পরে যখন ঝিলগুলি থেকে দূষিত হবে বায়ু, ময়নার মোড়ে মোড়ে গজিয়ে উঠবে চালের দোকান যা কোনদিন দেখেনি ময়নার মানুষ, দুপুর বেলায় গরম ভ্যাপসা বাতাস অস্থির করে দেবে জনজীবন, ছদ্ম বেকার মানুষ পাড়ি জমাবে বিহার কিংবা মহারাষ্ট্রে, সেদিন হয়তো মানুষের হুঁশ ফিরবে। টাকার নিচে চাপা পড়ে যাওয়া সবুজ ময়নাকে একবার হলেও মনে পড়বে


লেখকঃ- চিন্ময় বিশ্বাস (হাড়িপুকুর, নদীয়া)
[লেখক স্কুল শিক্ষক, ব্রজবল্লভপুর জুনিয়র হাই স্কুল,পূর্ব মেদিনীপুর]


© মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, ভূগোলিকা-Bhugolika, Geography & Environment, স্টুডেন্টস কেয়ার

Students Care

স্টুডেন্টস কেয়ারে সকলকে স্বাগতম! বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার সমস্ত খবরা-খবরের একটি অনলাইন পোর্টাল "স্টুডেন্ট কেয়ার"। পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সমস্ত চাকুরী প্রার্থীদের জন্য, এছাড়াও সকল জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গদের সুবিধার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।  

error: স্টুডেন্টস কেয়ার কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত !!