বিশেষ নিবন্ধ : বিশ্ব উষ্ণায়ন ,পরিবেশ এবং আমরা | লেখিকাঃ- নন্দিতা ভট্টাচার্য

পোস্টটি শেয়ার করুন
5/5 - (1 vote)

“দেখেছি আমারি হাতে হয়ত নিহত
ভাই, বোন, বন্ধু পরিজন পড়ি আছে
পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে।
এই পথে আলো জ্বেলে এপথেই পৃথিবীর
গ্রহমুক্তি হবে…
এ বাতাস, এ পরম সূর্যকরোজ্জ্বল
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে
দেখেছি যা হল, মানুষের যা হবার নয়”।।

পৃথিবীতে তিলতিল করে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতা এবং পুরো জীববৈচিত্র্যেই মানুষের কর্মকাণ্ডের ক্ষতিকারক দিকগুলোর প্রভাব পড়তে চলল। সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, মানুষের চাহিদা বেড়ে যাওয়া, যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং প্রচুর গাছ কেটে ফেলার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেল মাত্রাতিরিক্ত। আমরা জানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, ওজোন, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাসের মাত্রা বেড়ে গেলে পৃথিবী তার গৃহীত তাপের সবটাই মহাশূন্যে পাঠাতে পারে না। ফলে ওই গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলকে গরম করে। ফলত পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে যায় এই তাপমাত্রা। বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল মানুষের তৈরি দূষণ। দূষণের প্রভাব অতিরিক্ত ভাবে পড়েছে জলবায়ুর ওপর। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বাষ্পীভবনের মাত্রাও বেড়েছে। পৃথিবী জুড়ে বেড়েছে অত্যন্ত গতিসম্পন্ন ঘূর্ণবাত, ঝড়। আগে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলোতে বেশিরভাগ বৃষ্টিই হত শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি। এখন সেটা হয়ে গেছে প্রধানত নিম্নচাপজনিত ঘূর্ণবাতের ফলে সৃষ্ট বৃষ্টি।

গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন কমানোর রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকরী করা হয় কিয়োটো প্রোটোকলের মাধ্যমে। তবুও পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অনেক খারাপ প্রভাব নজরে পড়ার মত। বিশেষত উত্তর গোলার্ধের আর্দ্র অঞ্চলগুলোতে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়া, শুষ্ক অঞ্চলগুলোর শুষ্কতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য অ্যাসিড বৃষ্টি বা অম্লবৃষ্টির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। গাছেরা পুড়ে, চাষের ফসলও ঝলসে যায়। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় খরার সময়ও দীর্ঘ হয়। শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে গাছ না লাগালে সেগুলো প্রথমে খরাপ্রবণ ও পরে প্রায়-মরুঅঞ্চলে (Semi-arid Zone) খুব তাড়াতাড়ি পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। এভাবে চললে ভবিষ্যতে মানুষ পানীয় জলটুকুও পাবে কিনা সন্দেহ। তাই, “মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও…”।

Join us on Telegram

পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যেকবছর বঙ্গোপসাগরে জলের উষ্ণতা ০.০১৯° সেন্টিগ্রেড হারে বেড়ে চলেছে। উপকূলগুলো ভাঙছে, তলিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের অনেক দ্বীপ সমুদ্রের জলের তলায়। জলের তলও ক্রমশ বাড়ছে।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে চূড়ান্তমাত্রায় বেড়েছে দূষণ। ফল, সবসময়ের জন্য ধোঁয়াশা। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতাও এর আওতায়। ২২শে মার্চ, ২০২০ তারিখে করোনাভাইরাসকে রোখার জন্য মাত্র একদিনের ‘জনতা কার্ফু’তে দূষণের মাত্রা কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। কোলকাতায় নীল আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

দূষণের আওতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলও বাদ যায়নি। ফলে বেড়েছে খরা। পরিবেশকে অবিলম্বে বাঁচানো দরকার — এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ই জুন, ২০১৯ তারিখে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে গ্রামীণ স্কুলগুলোতে পড়ুয়াদের হাতে রোপণের জন্য চারাগাছ দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনদপ্তরের তরফ থেকে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া-বাঁকুড়া জেলায় আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।কালবৈশাখীর সংখ্যা কমেছে, ফলে গরমের প্রথমদিকে বৃষ্টি নামমাত্র। বিজ্ঞানীদের মতে এটাই ‘নিউ নর্মাল’, যার ফলে জার্মানিতে ২০১৯ সালে বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে।ল্যানসেটের মত বিজ্ঞান পত্রিকার মতে, শুধু ভারতেই হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। এরকম চলতে থাকলে পৃথিবী জুড়ে মানুষেরা গরমে পুড়বেন, বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়বে, অনেক গাছ ও প্রাণীর প্রজাতি হারিয়ে যাবে। সরকারি পদক্ষেপ তাই খুব দ্রুত দরকার। পশ্চিমবঙ্গে তাই সরকারি কর্মসূচি অনুযায়ী বিশ্ব পরিবেশ দিবসে স্কুলপড়ুয়াদের দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার পাঠ দেওয়া হচ্ছে জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্রের মাধ্যমে। পড়ুয়ারা দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের মধ্যে এই সচেতনতা আনতেই হবে, নইলে পৃথিবী হয়ত একদিন গ্যাস চেম্বারেই পরিণত হবে।

সচেতনতা খুব দ্রুত আনা প্রয়োজন। আন্টার্কটিকার এলিফ্যান্ট দ্বীপে বসবাসকারী চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনদের সংখ্যা কমছে। গত পঞ্চাশ বছরে ৭৭ শতাংশ কমেছে পেঙ্গুইনদের সংখ্যা। স্টোনিব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিথার লিঞ্চের কথায়, পেঙ্গুইনদের সংখ্যা বিপুল হারে কমার ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আন্টার্কটিকার বাস্তুতন্ত্র গত পঞ্চাশ বছরে আমূল বদলে গিয়েছে।চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনদের বাস করার মত সঠিক বা উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্রমশ কমছে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা। পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সরোবর হিসেবে বিবেচিত পুরুলিয়া জেলার সাহেববাঁধের সবুজ দ্বীপে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমেছে কারণ এই জেলায় শীতকাল খুব অল্প স্থায়ী হতে চলেছে।

দাবানল বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ার আরেকটি কারণ। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনে ২০১৯ এর দাবানল আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশাল খনি খনন করা হয় ওখানে খনিজের জন্য, গাছ কেটে ফেলে। বিশ্বের অক্সিজেনের উৎস আমাজন। দাবানলে শেষ হয়ে গেছে আমাজনের রেনফরেস্টের ২০ শতাংশ। অবিলম্বে সরকারি কর্মসূচি দরকার। যেমন পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলায় সরকারি নীতি অনুযায়ী প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে সঠিক সময়ে বৃষ্টির জন্য, খরা রোধের জন্য।

প্লাস্টিক পোড়ানোও বন্ধ করা দরকার। চল্লিশ মাইক্রনের থেকে কম পুরু প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। স্কুলে স্কুলে মধ্যাহ্ন খাবারের জন্য (মিড ডে মিল) ব্যবহৃত কাঠকয়লা থেকেও গ্যাস বাতাসে মিশছে। এক্ষেত্রে বায়োগ্যাস ব্যবহার করলে খরচও কমবে, বাতাসও দূষিত হবে না।

প্রয়োজন না হলে গাড়ি কম ব্যবহার করা যেতে পারে। কম দূরত্বে সাইকেল কিংবা টোটোয় যাতায়াতে দূষণ কমে। বিদ্যুৎ তৈরিতে প্রচুর কয়লা পোড়ানো হয়। এক্ষেত্রে ভারতের সৌরশক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

গ্রেটা থুনবার্গ যেমন প্রথমে এক, তারপরে সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে যেভাবে পরিবেশ রক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছেন, জলবায়ু আন্দোলনে সেভাবেই এগোতে হবে সবাইকে। তাঁর মতে মানুষ, প্রাণীর মারা যাওয়া, পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়া-সবকিছুর জন্য দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন। কাজেই প্রযুক্তি হাতে নিয়ে আমরা চুপ করে বসে থাকব না, এই পরিস্থিতি “আমরা করব জয়”। বিখ্যাত আচরণবিজ্ঞানী জেনগ গুডালের কথায়, “আমাকে সুস্থ থাকতেই হবে (I must stay healthy)”। আর তাই, সেভ নেচার, সেভ লাইফ, সেভ স্পেসিস।

কবিগুরুর কথায়,
“তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই
কতই কি চাই
দিনের শেষে ঘরে এসে
লজ্জা যে পাই”।।

লজ্জা গায়ে মেখে যার কাছে আমরা ঋণী, সেই বসুন্ধরাকে রক্ষা করার জন্য সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিন এসে গেছে।


লেখিকাঃ- নন্দিতা ভট্টাচার্য (আমডিহা, পুরুলিয়া)
[লেখিকা সহশিক্ষিকা, শান্তময়ী উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়]


তথ্যসূত্রঃ-

(১) ভূগোলিকা

(২) এবিপি আনন্দ

(৩) আনন্দবাজার পত্রিকা

(৪) আধুনিক ভূগোল ও পরিবেশ- হাজরা এবং হাজরা

© মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, ভূগোলিকা-Bhugolika, Geography & Environment, স্টুডেন্টস কেয়ার

Students Care

স্টুডেন্টস কেয়ারে সকলকে স্বাগতম! বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার সমস্ত খবরা-খবরের একটি অনলাইন পোর্টাল "স্টুডেন্ট কেয়ার"। পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সমস্ত চাকুরী প্রার্থীদের জন্য, এছাড়াও সকল জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গদের সুবিধার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।  

error: স্টুডেন্টস কেয়ার কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত !!