সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয় কিভাবে জেনে নিন অজানা কিছু তথ্য
সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয় কিভাবে
আমরা জানি বায়ুমন্ডলের বিস্তার ভূপৃষ্ঠ থেকে 10,000 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত. মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে বায়ুমন্ডল গোলাকার পৃথিবীকে সর্বদাই কম্বলের মতো জড়িয়ে থাকে, তার সব জায়গায় চাপ কিন্তু সমান নয়. কোথাও নিম্নচাপ আবার কোথাও উচ্চচাপ. আর এই চাপের পার্থক্যের ফলেই বায়ুপ্রবাহ ঘটে. তবে বায়ু সর্বদা উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়. বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বায়ুর এই প্রবাহের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে ছোটো-বড়ো স্বল্প ও দীর্ঘস্থায়ী নানান ধরনের গলো্যোগ সৃষ্টি হয়, সেগুলি কোথাও ঘূর্ণিপাকের আকারে, আবার কোথাও তরঙ্গের আকারে প্রবাহিত হয়. এই ধরনের অশান্ত অবস্থাকে বায়ুমন্ডলীয় গলোযোগ বলা হয়. বায়ুমন্ডলীয় গলোযোগের কয়েকটি উদাহরণ হল- ঘূর্ণবাত, প্রতীপ ঘূর্ণবাত, শিলাবৃষ্টি, ধূলিঝড়, বজ্রঝড় প্রভৃতি. আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হল ঘূর্ণিঝড়. আগে জেনে নেবো ঘূর্ণিঝড় কাকে বলে?
♠ঘূর্ণিঝড় বা ঘূর্ণবাত কাকে বলে?
ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধি বা অন্যান্য কারনে কোনো স্বল্প পরিসর স্থানে হঠাৎ বায়ুচাপ কমে গেলে সেই অঞ্চলের বায়ু উর্দ্ধমূখী হয় এবং চাপের সমতা বজায় রাখার জন্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বায়ু চক্রাকারে নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে পর্যায়ক্রমে প্রবেশ করে এবং সেটি উষ্ণ ও হাল্কা হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে উর্দ্ধমূখী হয়. এরূপ দ্রুতগতি সম্পন্ন উষ্ণ ঘূর্ণি বায়ু প্রবাহকে ঘূর্ণবাত বা ঘূর্ণিঝড় বলে.
♠ ঘূর্ণবাত শব্দের অর্থ-
বাংলা ঘূর্ণবাত শব্দের ইংরেজি নাম হল “সাইক্লোন” (Cyclone). ইংরেজি সাইক্লোন শব্দটির বুৎপত্তি গ্রিক শব্দ “Kukloma” বা “Kyklos” (সাপের কুন্ডলী থেকে. ক্যাপ্টেন হেনরি পিডিংটন 1848 সালে সাইক্লোন শব্দটি প্রথম ব্যাবহার করেন।
♠ ঘূর্ণবাতের প্রকারভেদ
উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঘূর্ণবাত দুই প্রকার. 1) ক্রান্তীয় বা উষ্ণমন্ডলীয় ঘূর্ণবাত 2) নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলীয় বা মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাত
ক) ক্রান্তীয় বা উষ্ণমন্ডলীয় ঘূর্ণবাত-
ক্রান্তীয় অঞ্চলে অর্থাৎ 5 ডিগ্রী থেকে 30 ডিগ্রী উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে সিমুদ্র থেকে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপ বিশিষ্ট প্রবল বিদ্ধংসী ঘূর্ণবাতকে উষ্ণমন্ডলীয় বা ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বলে.

খ) নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলীয় বা মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণবাত-
উভর গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশে (30 ডিগ্রী থেকে 65 ডিগ্রী) নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে মূলত স্থলভাগের নিম্নচাপ কেন্দের আকর্ষণে দুটি বিপরীতধর্মী ও বিপরীতমূখী বায়ুপুঞ্জের মিলনে উভয়ের সীমান্ততল বরাবর তরঙ্গের মাধ্যমে আলোড়ন ঘটে যে ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয় আকে নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলীয় ঘূর্ণবাত বলে.
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত কে নিয়ে. আপনাদের জানার জন্য আগেই বলে রাখি ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঘূর্ণবাত বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন নামে পরিচিত. নিচের ছকের মাধ্যমে জেনে নিন ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত কোথায় কি নামে পরিচিত–

এবার আসি মূল আলোচনায়. এতক্ষনে আপনারা জেনে গিয়েছেন যে, ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতকে সাইক্লোন নামে ডাকা হয়ে থাকে. এবার আপনারা লক্ষ করে থাকবেন যখনি আমাদের এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে তার একটি নির্দিষ্ট নাম থাকে এবং ওই নাম গুলি বিভিন্ন সময়ের ঘূর্ণিঝড়ের থেকে আলাদা হয়. এবার প্রশ্ন হল এই সকল ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয় কিভাবে ?
♠ ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয় কিভাবে –
নামকরণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে 2000 সালে ম্যাসকটে 27তম সম্মেলনে. ওই সম্মেলনে WMO (World Meteorological Organization) ও RSMC (Regional Specialised Meteorological Centre) দ্বারা অনুমদনের মাধ্যমে. ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় হলে তার নাম ঠিক করে দেওয়ার দায়ীত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতের দিল্লিস্থিত মৌসম ভবনকে.
♠ নামকরণের সতর্কতা-
সাইক্লনের নামকরণ করার আগে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, সেগুলি নিম্নরূপ-
অ) নামটি সংক্ষিপ্ত আকারে ও বোধোগম্য হতে হবে হবে. আ) নামের মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মীয় সংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা থাকা যাবেনা. ই) কোনো ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত না আনে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে. ঈ) নামের পূন:ব্যাবহার করা যাবেনা
♠ সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের পদ্ধতি –
প্রথমে বলে রাখি আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে আটটি দেশে. এই আটটি দেশ হল- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান ও থাইল্যান্ড. এই আটটি দেশের কাছ থেকে আটটি করে নাম সংগ্রহ করে মোট 64টি নামের তালিকা মৌসম ভবনে রাখা রয়েছে. এবার প্রথমে এই আটটি দেশের ইংরেজি নামের বর্ণানুক্রমে (Alphabetically সাজিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের দেওয়া নাম গুলিকে নির্দিষ্টক্রমে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে. নিম্নের তালিকাটি লক্ষ করুন.

এর পর যখন কোনো ঘূর্ণিঝড় হয় তখন একে একে পর্যায়ক্রমিক ভাবে নাম গুলিকে চিহ্নীত করে ঘূর্ণিঝড়গুলির নাম রাখা হয়. উদাহরনস্বরূপ বলা যায় সম্প্রতি 2018 সালে অক্টোবর মাসে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখা হয়েছে “তিতলি” যার অর্থ প্রজাপতি. এই নামটি নেওয়া হয়েছে পাকিস্তানের তালিকা থেকে. ঠিক একি প্রক্রিয়াতে এর পরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হবে “গিন্ডম” যেটি শ্রীলঙ্কার দেওয়া নাম.
[আরও পড়ুন- বর্তমানে ৮টি থেকে ১৩টি দেশ হয়েছে। কোন্ কোন্ দেশ তালিকা দেখুন]

♠ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘূর্ণিঝড়ের নাম-
ফাইলিন (থাইল্যান্ডের দেওয়া), নার্গিস (পাকিস্তান), হুধুদ (ওমান), প্রিয়া (শ্রীলঙ্কা), লেহের (ভারত), হেলেন (বাংলাদেশ), আয়লা (মালদ্বীপ) প্রভৃতি.
♠ আপনিও কি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করতে পারবেন?
হ্যা, পারবেন, সাধারন নাগরিক যদি উপরিউক্ত শর্তগুলি মেনে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিতে চায় তাহলে একটি সুন্দর নাম চিহ্নীত করে নিম্নলিখিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে. এর পর কতৃপক্ষের পছন্দ হলে আপনার দেওয়া নামটি পরবর্তীকালে তালিকাভূক্ত হতে পারে-
পারে-ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে এই ঠিকানাতে পাঠাবেন-
To
The Director General of Meteorology
Indian Meteorological Department
Mousam Bhawan Lodi Road
New Delhi, 110003
ধন্যবাদ সকলকে আমাদের সাথে এতক্ষণ থাকার জন্য. তথ্যগুলি ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সেয়ার করে নেবেন
Tag- সাইক্লোনের নামকরণের পক্রিয়া, ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের পক্রিয়া, তিতলি নামকরণ করেছে কোন দেশ, ঘূর্ণিঝড়ের নামকরন হয় কিভাবে