পশ্চিমঘাটের রূপকথা : একটি অনন্য বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশের বিবরণ | কোয়েল বসু

পোস্টটি শেয়ার করুন
5/5 - (1 vote)

ভারতীয় উপদ্বীপের পশ্চিমকূল তথা আরবসাগরের পাড় বরাবর উত্তর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ যে পর্বত মালার অবস্থান ভারতীয় মানচিত্রে সুস্পষ্ট তাই হল পশ্চিমঘাট পর্বত (Western Ghats Mountain), যার অপর নাম সহ্যাদ্রি পর্বত মালাইউনেস্কো (UNESCO) প্রদত্ত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা প্রাপ্ত এই অঞ্চল বিশ্বের আটটি প্রধান জীববৈচিত্রের উষ্ণবিন্দু (Biodiversity Hotspot) গুলির মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করেছে। অঞ্চলটি তার নিজস্ব বাস্তুতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ভারতের অন্যতম একটি জৈবিক অঞ্চল (Biotic Region) বলেও সুপ্রসিদ্ধ।

এখানে বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চল বা জৈবিক অঞ্চল কথাটির একটি সুস্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রকৃতি, তাদের বৈশিষ্ট্য ও আঞ্চলিক বন্টন অনুসারে পৃথিবীর সমগ্র জীবমন্ডলকে বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলে একই ধরনের পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় এবং প্রাকৃতিক ভাবে একই রকমের জীব সমূহের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয় সেই সব ভৌগলিক এলাকা একই জৈব ভৌগলিক এলাকার অন্তর্গত। কোনো একটি নির্দিষ্ট জৈবিক এলাকার সকল উদ্ভিদ, প্রাণী, মৃত্তিকা, জলবায়ু একই প্রকৃতির হয়ে থাকে। ভারতে মোট দশটি এই ধরনের জৈবিক এলাকা রয়েছে। যার মধ্যে ভারতের পশ্চিম উপকূলের সমান্তরালে অবস্থিত পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্র শুধু ভারত নয় সমগ্র পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের এক অগাধ ভান্ডার।

[প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ২০২০-র সমস্ত প্রবন্ধ পড়ুন এক ক্লিকে]

ভারতীয় উপদ্বীপের দক্ষিণতম বিন্দু তথা ৮৹৪”উ: অক্ষরেখা থেকে উত্তরে তাপ্তি নদীর মোহনা পর্যন্ত অর্থাৎ ২১৹উ: অক্ষরেখা পর্যন্ত প্রসারিত এই পর্বতমালার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০০ কিমি এবং প্রস্থ প্রায় ১০০ কিমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে স্থানটির গড় উচ্চতা প্রায় ৯০০ থেকে ১৫০০ মিটার। প্রধানত মালাবার উপকূল তথা কেরালা, পশ্চিম তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, গোয়া এবং কঙ্কন উপকূল তথা মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের পশ্চিম কূল বরাবর অবস্থান করছে এই পর্বতমালা। এই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলটির মোট আয়তন ১৮০০০০ বর্গ কিলোমিটার। ইহা ভারতের মোট আয়তনের প্রায় ৬% জুড়ে তার ভূমি আবরণ (Land Cover) বিস্তার করেছে।

Join us on Telegram

সমগ্র পশ্চিমঘাট পর্বতমালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অতুলনীয়। চারদিকে সবুজের সমারোহ, মাঝে কুয়াশার পাতলা সাদা আচ্ছাদন যেন এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আনাইমুদির (২৬৯৫মি) শিখর থেকে উপত্যকার দিকে তাকালে মনে হয় সমগ্র উপত্যকা জুড়ে পাতা রয়েছে সবুজ গালিচা। বর্ষায় সবুজের ঘনত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। ভেজা পাতা, বনের গন্ধ আর গাঢ় সবুজ রঙে প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দেয়।

 

অঞ্চলটির সৃষ্টির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মূলত আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপের অংশ এই ভূমিভাগ। উভয় স্থানে বসবাস রত জীবগোষ্ঠীর সাদৃশ্যই তার সাক্ষ্য বহন করে। ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে মহাদেশীয় সঞ্চরণ (Continental Drift) এর প্রভাবে গন্ডোয়ানা ভূমিভাগের অংশ হিসাবে ইহার উত্তরমুখী সরণ ঘটে। এরপর ক্রিটাশিয়াস যুগের শেষের দিকে গন্ডোয়ানা ভূমিভাগের এই উপদ্বীপীয় অংশে অগ্ন্যুৎপাতের সূচনা হয় এবং ইহা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়।এই অগ্ন্যুৎপাতের লাভা সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি হয় দাক্ষিণাত্য মালভূমি। এই মালভূমির পশ্চিম প্রান্তের চ্যুতি পূর্ণ, খাড়া ঢাল বিশিষ্ট, সুউচ্চ, বন্ধুর ভূমিভাগই হল পশ্চিমঘাট পর্বতমালা।

লাভা দ্বারা গঠিত হওয়ার কারণে স্থানটিতে ব্যাসল্ট শিলার প্রাধান্য দেখা যায়। এছাড়া চুনাপাথর, ল্যাটেরাইট ইত্যাদি শিলাও স্থান বিশেষে অবস্থান করে। এই শিলাগুলি থেকে উৎপন্ন কৃষ্ণ মৃত্তিকা, ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার ওপর অরণ্যজাত হিউমাসের স্তরও সুস্পষ্ট, যা উদ্ভিদের বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক।

এই সুউচ্চ পর্বত দক্ষিণ ভারতের নদী ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য জলবিভাজিকা।এই ভূমিভাগ দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ নদীর উৎস স্থল এবং এর অবস্থান উৎস থেকে গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ইত্যাদি নদীগুলির প্রবাহকে পূর্ব বাহিনী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর্বতের পশ্চিম ঢাল বরাবর রয়েছে পেরিয়ার, পাম্বা, নেত্রবতী, সারাবতী, মান্ডভী প্রভৃতি খরস্রোতা নদীর প্রবাহ। পাহাড়ের বন্ধুরতার কারণে নদীর প্রবাহ পথে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু ছোটো বড় জলপ্রপাত। যার মধ্যে মান্ডবী নদীর দুধ সাগর ও শরাবতী নদীর যোগ জলপ্রপাত তাদের সৌন্দর্যে অতুলনীয়।

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অবস্থান ভারতীয় জলবায়ু, বিশেষত বৃষ্টিপাতের ওপর যেমন প্রভাব বিস্তার করে তেমনি জলবায়ুর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রকও প্রভাব ফেলে এই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলের জীববৈচিত্রের ওপর। আরব সাগর থেকে আগত দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ু মালাবার উপকূলে পশ্চিমঘাটের পশ্চিম ঢালে বাধা প্রাপ্ত হয়ে প্রবল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। এখানে সর্বোচ্চ নথিভুক্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৯০০ সেমি এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০০-৪০০সেমি। মৌসুমী বায়ুর এই শাখাটি পর্বতগাত্র বরাবর যত উত্তরমুখী হয় ততই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। যার প্রভাবে পশ্চিমঘাটের উত্তরাংশে উদ্ভিদের প্রকৃতিও আলাদা হয়ে থাকে। পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত পালঘাট গিরিপথ, ভোরঘাট ও থলঘাট গিরিপথ ধরে কিছু জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু দাক্ষিণাত্য মালভূমির দিকে প্রবেশ করে, যা পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে অল্প বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই স্থানের বার্ষিক গড় উষ্ণতা ১৫৹সে:, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও অত্যন্ত বেশী। আলোচ্য এই সকল জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য এই স্থানে গভীর অরণ্য সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে এবং অঞ্চলটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের জীব বৈচিত্র্যের একটি উষ্ণতম উষ্ণবিন্দু।

সমগ্র ভারতের মোট বনভূমির প্রায় ৩০% রয়েছে এই পশ্চিমঘাট পর্বতমালায়। ১৯০৪ সালে প্রখ্যাত ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ জোসেফ ডালটন হুকার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার স্বাভাবিক উদ্ভিদের বন্টনকে মূলত চার ভাগে ভাগ করেন। তাঁর মতানুসারে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০-১৫০০ মিটার উচ্চতায় যেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫০-৫০০ সেমি সেখানে প্রধানত ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্যের সমাবেশ দেখা যায়।এই অরণ্য অঞ্চল অত্যন্ত ঘন এবং আর্দ্র। অরণ্যের কাষ্ঠল বৃক্ষের গাছ গুলি প্রায় ৬০ মিটার লম্বা। গাছের পাতা যথেষ্ট বড় যা অতিরিক্ত বাষ্পীভবনের উপযোগী। এই অভিযোজন গত বৈশিষ্ট্য গাছ গুলিকে অতি আর্দ্র পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। বনভূমির মাথার উপর চাঁদোয়া আকৃতির লতা ও পরজীবী উদ্ভিদের আস্তরণ দেখা যায়, উদ্ভিদ বিদ্যায় যা ক্যানপি (Canopy) নামে পরিচিত। এই আচ্ছাদনের কারণে সূর্যের আলো বনভূমির মধ্যে সহজে প্রবেশ করতে পারে না। তাই দিনের বেলাতেও বনভূমি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। অতি আর্দ্রতার কারণে জঙ্গলের ভূমিভাগে বিভিন্ন প্রজাতির মস, ফার্ন, শ্যাওলার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফল ও ফুলগাছ।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০-৯০০ মিটার উচ্চতায় যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫০-৩০০ সেমি, সেখানে অবস্থান করছে আর্দ্র পর্ণমোচী অরণ্য। হরিণহারা, কনকচাঁপা, টিক, মালাবার অ্যালমন্ড প্রভৃতি এই অরণ্যের উল্লেখযোগ্য বৃক্ষ সমূহ। ৩০০-৯০০ মিটার উচ্চতায় যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনামূলক কম ১০০-২০০ সেমি মধ্যে, সেখানে অবস্থান করছে শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্য। রিঠা, শিরীষ, চন্দন, রাবার, পলাশ, নিম, কাঞ্চন প্রভৃতি এই অরণ্যের প্রধান বৃক্ষ। পর্ণমোচী বৃক্ষের অরণ্য চিরহরিৎ অরণ্যের ন্যায় অতো ঘনসন্নিবিষ্ট নয়। গাছগুলির উচ্চতাও কিছুটা কম। বছরের শুষ্ক মরসুমে এই অরণ্যের সকল বৃক্ষই পাতাবিহীন হয়ে পরে।

পশ্চিম উপকূলের যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনামূলক কম, মাত্র ৩০-৬০ সেমি সেখানে দেখা যায় কাঁটা ঝোপ, অ্যাকাসিয়া, বৈচি, হলুদ গাছের গুল্ম।

জে.ডি. হুকার আরও বলেন ১৫০০ মিটার উচ্চতায় পর্বত্য ভূমিতে দেখা যায় তৃণভূমির বিস্তার, যা স্থানীয় ভাষায় শোলা (Shola) নামে পরিচিত। সাভানা জাতীয় তৃণের বিস্তারও দেখতে পাওয়া যায় ১৭০০-২০০০ মিটার উচ্চতায়। উচ্চ বৃষ্টিবহুল সাভানা অঞ্চলে দেখা মেলে রডডেনড্রন ও বিভিন্ন ঔষধি গুল্মের।

ভারতের প্রায় ৮০% ফুলের গাছ রয়েছে এই পর্বত মালার গভীর অরণ্যে। এখানে আছে প্রায় ৪০০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ। যার মধ্যে ১৫০০ প্রজাতির সন্ধান মেলে শুধু মাত্র এই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলে। নীলগিরি পর্বতের ঢালে এক বিশেষ ধরনের সপুষ্পক উদ্ভিদ জন্মায় যার নাম নীলাকুরিঞ্জি (Neelakurinji)। নীলচে বেগুনি রঙের এই ফুলটি ১২ বছর অন্তর একবার প্রস্ফুটিত হয়। যখন এই ফুল প্রস্ফুটিত হয় তখন সমগ্র পাহাড়ের গায়ে নীলের অপরূপ আস্তরণ তৈরি করে।নীলাকুরিঞ্জি তার অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য পশ্চিমঘাটের রাণী বলেও পরিচিত।

এছাড়াও নাগচাঁপা, চামেলি, অশোক, বকুল, বিভিন্ন প্রকার পদ্ম, শালুক, কামেনী, নাগকেশর, মাধবীলতার রঙে গন্ধে ভরে থাকে অরণ্যের পরিবেশ।

প্রায় ৭০০ প্রজাতির ঔষধি গাছের দেখা মেলে এই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলের মধ্যে। এখানে প্রাপ্ত লজ্জাবতী লতা (Mimosa Pudica), জবা (Hibiscus Angulosus), দ্রণপুষ্প (Leucas Aspera), ভুঁইআমলা (Phyllanthus Neruri), আকন্দ ( Calotropis Gigantea) এই গাছগুলির ঔষধি গুণ জন্ডিস, হাঁপানি, অর্শ, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে সক্ষম। ভল্লাতক (Semecarpus Anacardiu), বনআলু (Dioscorea Bulbifera) ইত্যাদি ঔষধি গাছ বিভিন্ন প্রকার টিউমার সংক্রান্ত রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। কাঁকরোল (Momordica Dioica), দারুচিনি (Cinnamomum Zeylanicum), রঞ্জনকালী (Ophiorhizza Mungos) ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার্য। সর্পগন্ধা (Rauvolfia Serpentina), অশোক (Saraca Asoca), কুচিলাফল (Nux Vomica), বিষলাঙ্গুলি (Gloriosa Superba) বিলুপ্ত প্রায় এই ঔষধি গাছগুলিও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী। (তথ্যসূত্রঃ- Sahyadri E-News:IssueXll)

পর্বত গাত্রে রয়েছে প্রায় ১২৮ রকমের অর্কিড, যা তাদের ফুলের সৌন্দর্য, রঙ, আকার, প্রকৃতি, অভিযোজনের ধরনের জন্য প্রসিদ্ধ। অর্কিড গুলির ফুল ধারণের সময় সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস। অর্কিডের আকার গুলিও বেশ অদ্ভুত। নেকলেস অর্কিড (Pholidota imbricata) দেখতে ঠিক মুক্তোর হারের মতো। আবার অন্য একটি অর্কিড দেখতে কতকটা মাকড়সার ন্যায় (Habenariamulticaudata)

বিভিন্ন প্রকার সুগন্ধি ও ব্যবহার্য মশলা গাছেরও সন্ধান মেলে এই অরণ্যে। এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, মরিচ, হলুদ, আদা, জায়ফল, জৈত্রি ইত্যাদির পাশাপাশি পাওয়া যায় কফি ও ভ্যানিলার গুল্ম।

উদ্ভিদের বৈচিত্র্যময় পরিবেশের মধ্যে পশ্চিমঘাটের অরণ্য অঞ্চলে বসবাস করে একটি বিশাল প্রাণী জগৎ। অরণ্যের প্রকৃতি ভেদে এদের বাসস্থান ভিন্ন হয়ে থাকে।যেমন চিরহরিৎ অরণ্যের ভূমিভাগ ঝোপ জঙ্গলে পূর্ণ হওয়ায় এখানে ভূমিতে বিচরণকারী প্রাণী বিশেষ দেখা যায় না। এই অরণ্যের প্রাণীরা প্রধানত উদ্ভিদের শাখায় বসবাস করে। এখানে দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদর, কাঠবিড়ালি ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। আবার পর্ণমোচী অরণ্য হরিণ, হাতি, বাঘ, বাইসনদের বিচরণ ক্ষেত্র। যেহেতু এই অরণ্যের গভীরতা কম তাই বড় এই স্তন্যপায়ী প্রাণী গুলি সহজেই জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে।

এখন আসা যাক এই অরণ্য অঞ্চলটির প্রাণী বৈচিত্র্যের একটি পরিসংখ্যানে। ইউনেস্কো প্রদত্ত তথ্যানুসারে এই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চল প্রায় ১৭৯ প্রজাতির উভচরপ্রাণী, ১৫৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ২১৯ প্রজাতির মাছের বাসস্থান। আবার ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড (WWF) এর তথ্যানুযায়ী ১৩৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫০৮ প্রজাতির পাখি, ৩৩০ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে এই অরণ্যে।

অরণ্যের উল্লেখ যোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলির মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০০০০ এশীয় প্রজাতির হাতি (তথ্য -WWF)। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, ভারতীয় চিতা, কালো চিতা, ঢোল বা হিংস্র বন কুকুর, গৌর বা ইন্ডিয়ান বাইসন। এই অরণ্য অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৭ প্রজাতির বাঁদর। যার মধ্যে লায়ন টেল ম্যাকাক নামক ছোটো লেজ বিশিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ বাঁদর, নীলগিরি লেঙ্গুর, ধূসর লেঙ্গুর ইত্যাদি এখানকার বিরল বাঁদর প্রজাতি। বিরল প্রাণীগুলির মধ্যে আরও রয়েছে, নীলগিরি থর নামক মেষ জাতীয় প্রাণী, নীলগিরি মার্টেন বা নেউল, খট্টাস, বাঘরোল, গন্ধগোকুল, জায়ান্ট স্কুইরেল নামক অতিকায় কাঠবেড়ালি প্রভৃতি।

অরণ্যের গভীরে পাওয়া যায় রঙ বেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, যাদের মধুর কন্ঠ, পালকের রঙের বাহার, ঠোঁটের বহর বা নাচের ধরণ অতীব সুন্দর। নীল রঙের নীলগিরি সোলাকিলি, বসন্তবৌড়ী ও বিভিন্ন প্রজাতির বুলবুল- যাদের কারুর গলার কাছের পালক আগুন রঙা, কারুর আবার মাথার রঙ ধূসর এদের সবার গায়েই রয়েছে নানা রঙের পালকের বাহার। নীলগিরি থ্রাস, বৌ-কথাকও, ময়না, এশিয়ান কোয়েল, দোয়েল পাখিগুলির গলার স্বর অতিমধুর। বিভিন্ন প্রজাতির টিয়ার মধ্যে রয়েছে নীল পাখা বিশিষ্ট ব্লু উইং প্যারাকীট বা নীল টিয়া। এছাড়াও রয়েছে ধনেশ, ছাতারে, হাঁড়িচাঁচা, কাঠপায়রা, মুনিয়া, বাবুই, লম্বা লেজের দুধরাজ বা শাহবুলবুল, ফটিকজল, শ্বেতাক্ষী, নীলগিরি ফ্লাই ক্যাচার প্রভৃতি। পেঁচা ছাড়াও রয়েছে অদ্ভুত দর্শন নিশাচর পাখি ফ্রগমাউথ যার ঠোঁটের আকার খানিকটা ব্যাঙের মতো।

লেখা পাঠান এই ইমেলে- [email protected]

চিরহরিৎ অরণ্যের ভূমিভাগে রয়েছে অনেক বিরল প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস। অন্ধকারাচ্ছন্ন, আর্দ্র পরিবেশে গড়ে উঠেছে তাদের উপযোগী বাসস্থান। যার মধ্যে বেগুনি ব্যাঙ বা পারপেল ফ্রগ, উড়ুক্কু ব্যাঙ বা মালাবার ফ্লাইং ফ্রগ এবং ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের (৩.৬সেমি) ইন্ডিয়ানা সেমিপালমাটা বিজ্ঞান সম্মত নামের বিশেষ দক্ষিণ ভারতীয় ব্যাঙ উল্লেখযোগ্য। জঙ্গলে রয়েছে সবচেয়ে লম্বা রাজ গোখরো, মন্থর গতির মালাবার পিট ভাইপার, বাঁশ গাছে লুকিয়ে থাকা সবুজ পিট ভাইপারের মতো প্রচন্ড বিষধর সাপ। এই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলে ১২০০মিটার উচ্চতা পর্যন্ত সাপেদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়, যা পৃথিবীর সাপেক্ষে সাপেদের সর্বোচ্চ অবস্থান। এছাড়া সরীসৃপদের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু প্রজাতির গিরগিটি, যারা বহুরূপী সেজে ছড়িয়ে রয়েছে জঙ্গলের আনাচে কানাচে।যেমন অতিকায় মনিটর লিজার্ড।

অরণ্যের ফুল গাছগুলিতে উড়ে বেড়াতে দেখা যায় অসংখ্য প্রজাপতি। কেউ থাকে বনভূমির খুব উঁচুতে, আবার কেউ নিচের ঝোপ ঝাড়ের ওপর। তাদের ডানার রঙ বৈচিত্র্যও অসাধারণ যেমন স্যালোটেল বাটারফ্লাই, বুদ্ধ ময়ূরী প্রজাপতি, তামিল লেশ উইং প্রজাপতি ইত্যাদি।

অরণ্যের এই বিশাল প্রাণ প্রাচুর্যের মধ্যে অরণ্য সম্পদকে কেন্দ্র করে বসবাস করে টোডা, কোটা, কুরুম্ব, বাদাজে নামক আদিবাসী জনজাতির মানুষজন। পাহাড়ের ঢালে, গভীর অরণ্যে নিজেদের রীতি, নীতি লোকাচার অনুসরণ করে এরা জীবন যাপন করে। পশ্চিমঘাট পর্বতের এই বিশাল অরণ্য বাস্তুতন্ত্র সমগ্র ভারতের একটি বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারই শুধু নয় ভারতের পরিবেশের ওপর এর গুরুত্ব অপরিসীম। অক্সিজেন উৎপন্ন করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের শহরগুলির দূষণ রোধে ফুসফুসের ন্যায় ভূমিকা পালন করে এই অরণ্য। অরণ্যের প্রকৃতিক শোভা পর্যটন কেন্দ্র বিকাশে সহায়ক হয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্বও পালন করে। এছাড়া অরণ্যের অগাধ বনজ সম্পদ বিভিন্ন সময়ে আমাদের চাহিদা পূরণ করে থাকে। তবে বর্তমানে এই বিশাল বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চল কঠিন সমস্যার সম্মুখীন। জনবসতির বিস্তার, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিল্পের বিকাশ, জল বিদ্যুৎপ্রকল্পের বিস্তার ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বিগত ১৭ বছরে অরণ্যের মোট আয়তন উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছর গুলিতে হ্রাস প্রাপ্ত বনভূমির পরিমাণ ১৯৬৭০.২ হেক্টর। অঞ্চলটিতে লক্ষ্যণীয় ভাবে তৈরী হয়েছে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত (Human Animal Conflicts)। নদীগুলিতে দূষিত জলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্র যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি হাতিদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে পানীয় জলের অভাব। হাতির চলার পথে বৈদ্যুতিক খুঁটি তাদের মৃত্যু সংখ্যা বাড়াচ্ছে। চোরাচালান একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক কালে। দেশী ও বিদেশী কালোবাজারে চড়া দামে পাচার হচ্ছে মহা মূল্যবান চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত, ঔষধি গাছ ও সাপের বিষ।

অরণ্য অঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার কারণে ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সমগ্র বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলে গড়ে উঠেছে মোট ৩৯ টি জাতীয় উদ্যান ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের এলাকা। তবুও মানুষের কিছু বিবেচনা হীন ক্রিয়া কলাপ অরণ্যের পশু ও পক্ষী কুলের নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ আশ্রয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রমশ।

সচেতন হবার সময় এসেছে। পরিবেশের সাথে দ্বন্দ্ব নয়, পরিবেশ মিত্র হয়ে, তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, প্রাকৃতিক পরিবেশের রক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার শপথ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে আমাদের সকলকে এক সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য।


লেখকঃ- কোয়েল বসু (শ্রীরামপুর, হুগলি)
[লেখিকা সহ শিক্ষিকা, মারিয়াস ডে স্কুল, রামরাজাতলা]


তথ্যসূত্রঃ-

(১) Biodiversity of the Western Ghat- An Overview
R.J Ranjit Daniels. Chapter-2

(২) Sahyadri E-news Issue XII,

(৩) www.wikipedia.org

(৪) Endemic Birds of Western ghat, jlrexplore.com

(৫) www.iucnredlist.org

(৬) www.indiabiodiversity.org

(৭) Flowers of Western Ghat, www.flowersofindia.net

(৮) www.wwfindia.org

(৯) www.whc.unesco.org

(১০) www.thehindu.com

© মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, ভূগোলিকা-Bhugolika, Geography & Environment, স্টুডেন্টস কেয়ার

Students Care

স্টুডেন্টস কেয়ারে সকলকে স্বাগতম! বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার সমস্ত খবরা-খবরের একটি অনলাইন পোর্টাল "স্টুডেন্ট কেয়ার"। পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সমস্ত চাকুরী প্রার্থীদের জন্য, এছাড়াও সকল জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গদের সুবিধার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।  

error: স্টুডেন্টস কেয়ার কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত !!