মুঘল সম্রাট বাবর এর জীবনী: নাম, জন্ম, মৃত্যু, 4টি যুদ্ধজয়, আত্মজীবনী Free PDF

পোস্টটি শেয়ার করুন
4.3/5 - (3 votes)

ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় জহিরুদ্দীন মহম্মদ বাবর এর হাত ধরে। সম্রাট বাবর ‘বাবুর’ নামেই বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। বাবরকেই ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা (Founder of Mughal dynasty of India) হিসাবে ধরা হয়। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক।

পরিচ্ছেদসমূহ

মুঘল সম্রাট বাবর এর জীবনী PDF (সংক্ষেপে)

আসল নামমির্জা জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর (Zahiruddin Muhammad Babur)
জন্ম14 ই ফেব্রুয়ারি 1483
মৃত্যু26 শে ডিসেম্বর 1530
জন্মস্থানতুর্কিস্থানের ফারগানায়
বাবার নামদ্বিতীয় ওমর শেখ মির্জা
মায়ের নামকুতলুগ নিগার খানম
সমাধিবাগ-ই-বাবর
আত্মজীবনী“তুজুক-ই-বাবরী” বা “বাবরনামা”
Samrat Babar Biography in Bengali

Samrat Babar Biography in Bengali

মুঘল সম্রাট বাবরের প্রকৃত নামঃ

বাবরের পুরোনাম মির্জা জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর (Zahiruddin Muhammad Babur)। তুর্কিস্থানের লোকেদের তার নাম নিতে অসুবিধা হয়, তাই সেখানকার লোকেরা তাকে বাবর (Babar) বলে ডাকত।

“বাবর” শব্দের অর্থঃ

তুর্কি ভাষায় বাবর শব্দের অর্থ হল “সিংহ” বা “বাঘ”। তিনি প্রকৃতই পুরুষ সিংহ ছিলেন।

বাবরের জন্ম পরিচয়ঃ

জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বা বাবর 1483 সালের 14 ফেব্রুয়ারি পঃ-মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্থানের ফারগানা প্রদেশের আনদিজান শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ফারগানা প্রদেশ বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। আন্দিজানির বা আনদিজান শহরের সকলে তুর্কি ছিলেন, এই অঞ্চলের সকলেই তুর্কি নামে পরিচিত ছিল।

Join us on Telegram

আরও পড়ুনঃ ভারতের রাজবংশের তালিকা PDF

বাবরের বংশ পরিচয়ঃ

পিতার দিক থেকে বাবর ছিলেন বিখ্যাত তুর্কি বীর তৈমুর লং ও মাতার দিক থেকে মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খাঁ এর বংশধর বা পূর্বপুরুষ। সম্রাট বাবরের পিতার নাম “দ্বিতীয় ওমর শেখ মির্জা” (Umar Shaikh Mirza II), যিনি তৈমুর এর তৃতীয় পুত্র মীরন সাহ এর বংশ তালিকার তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরসূরী ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রথম ওমর শেখ মির্জা (Umar Shaikh Mirza I) ছিলেন তৈমুর লং এরপ্রথম পুত্র।

অন্যদিকে বাবরের মাতার নাম “কুতলুগ নিগার খানম” (Qutlugh Nigar Khanum), যিনি চেঙ্গিস খাঁ বংশ তালিকার 13তম উত্তরসূরী ইউনুস খাঁ এর কন্যা ছিলেন। বাবরের পিতা ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন।

1508 খ্রিস্টাব্দে বাবরের তৃতীয় স্ত্রী মোহম বেগমের গর্ভে নাসিরউদ্দিন হুমায়ুন জন্মগ্রহণ করেন। মনে করা বাবরে বৈধ স্ত্রীর সংখ্যা ছিল সাত জন। বাবরের উল্লেখযোগ্য পুত্র সন্তানদের নাম হল হুমায়ুন-আশাকরি-কামরান এবং হিন্দালগুলবদন বেগম ছিলেন বাবরের কন্যা সন্তান, যিনি পরবর্তীকালে সম্রাট হুমায়ুনের জীবন কাহিনী নিয়ে ফার্সী ভাষায় “হুমায়ুননামা” লেখেন।

বাবরের মাতৃভাষা কি ছিল?

বাবরের মাতৃভাষা ছিল “চাঘাতাই”। তিনি চাঘাতাই ভাষাতেই কথা বলতেন যা তার কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া তৈমুরের বিত্তবানদের প্রধান ভাষা “পার্সি” ভাষাও তার যথেষ্ঠ দখল ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাবরের আত্মজীবনী “বাবরনামা” চাঘাতাই ভাষাতেই রচিত। যার ভাষা, বাক্য গঠন, শব্দ মূলত পারস্য ভাষার অনুসারী।

বাবরের সিংহাসন লাভ ও রাজ্যভিষেক

1494 খ্রিষ্টাব্দের 10ই জুন ফরগানার (উজবেকিস্তান) আকসি দুর্গে আকস্মিক বিস্ময়কর দুর্ঘটনায় পিতার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সূত্রে বাবর মাত্র 11 বছর 3 মাস (বা 12 বছর বয়সে) ফারঘনা প্রদেশের সিংহাসনে বসেন এবং রাজ্যভিষেক ঘটে।

সম্রাট বাবরের সামরিক জীবন

ইতি মধ্যে তার চাচা অনবরত তাকে সিংহাসন চ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলতাও পেয়েছিলেন ফলে বাবর ক্ষমতাচ্যূত হয়। এর পর তিনি জীবনের বেশকিছু সময় আশ্রয়হীন এবং যাযাবর জীবনযাপন করেন।

1497 সালে সমরখন্দের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে তিনি সমরখন্দ দখল করে নেয়। বলাবাহুল্য তাঁর সৈনদল তাঁর সঙ্গ না দেওয়ার ফলে সমরখন্দ পুনরায় তাঁর হাতছাড়া হয় এবং তাঁর নিজের রাজ্য ফরগানা প্রদেশ থেকেও তিনি বিতারিত হন।

1501 সালে পুনরায় সমরকন্দের দখল নেওয়ার চেষ্টা করলে পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ  উজবেক শাসক মোহাম্মদ শেবানী খান (Muhammad Shaybani Khan) এর কাছে পরাজিত হন। এরপর 1503 খ্রিস্টাব্দে ফরগনা প্রদেশ দখলের চেষ্টা করলে “আর্চিয়ানের যুদ্ধে” শেবানী খান এর কাছে পরাস্ত হন। এরই মাঝে তিনি একটি শক্তিশালী সৈনদল প্রস্তুত করার দিকে মনযোগী হন।

1504 খ্রিষ্ট্রাব্দে তুষার সমৃদ্ধ অঞ্চল হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে উলূঘ বেগের শিশুপুত্র আব্দুর রজ্জাকের কাছ থেকে কাবুল দখল করেন। এই বিজয়ের ফলে বাবর “আফগানিস্তানের বাদশাহ”-উপাধি নেন। এরপর 1507 খ্রিস্টাব্দে গজনী দখল করে। 1508 সালে “পাদশাহ” বা “বাদশাহ” বা “সম্রাট” উপাধিতে ভূষিত করেন।

বাবরের ভারত আক্রমনের ইতিহাসঃ

1519 খ্রিষ্ট্রাব্দে 2000 অশ্বারোহির সাথে খাইবারপাশ দিয়ে বাবর প্রথম ভারত আক্রমন করে বাজাউর দখল করেন। এটি পাঞ্জাবের ঝিলম নদীর তীরে ভেরার নামক একটি স্থান। বাবর ভেরার যুদ্ধে প্রথম কামানের ব্যবহার করেন।

1519 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বাবর দ্বিতীয় বার ভারত আক্রমণ করে খিজিরখালি আফগানদের হারিয়ে পেশোয়া দখল করেন। কিন্তু বাদখশানে বিদ্রোহ শুরু হলে বাবর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। 1520 খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বার বাবর ভারত আক্রমণ করেন। এইবার বাজাউর, ভেড়া এবং শিয়ালকোট খুব সহজে দখল করেন কিন্তু কান্দাহারে বিদ্রোহ শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

1524 খ্রিস্টাব্দে বাবর আবারও ভারত আক্রমণ করেন। এই সময় লাহোরের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদী ও তার পুত্র দিলওয়ার খান এবং গুজরাটের শাসনকর্তা আলম খাঁ লোদি বাবরের সাহায্য পাঠান। ঐ বছরই বাবর লাহোর ও দীপালপুর অধিকার করেন। কিন্তু অভিযানের মাঝপথে দৌলত খাঁর সাথে বাবরের মতবিরোধ দেখা দিলে বাবর কাবুলে ফিরে যান। দৌলত খাঁ লোদী লাহোর পুনরুদ্ধার করেন।

এর পরের বছর, 1525 খ্রিষ্টাব্দে তিনি, কামান, বন্দুক এবং বারো হাজার সৈন নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। দৌলত খাঁ লোদিকে পরাত করে পাঞ্জাব দখল করার পর তিনি দিল্লির দিকে অগ্রসর হয়। তখন দিল্লির সিংহাসনে ইব্রাহিম লোদি।

দিল্লির কাছে পানিপথের প্রান্তরে 1525 খ্রিষ্টাব্দে 21শে এপ্রিল সম্রাট বাবর ও ইব্রাহিম লোধির মধ্যে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পঞ্চম বার ভারত অভিযানের প্রচেষ্টায় ইব্রাহিম লোধিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাস্ত করে বাবর দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়।

সম্রাট বাবরের আমলে ঐতিহাসিক যুদ্ধ বিজয় তালিকা

যুদ্ধতারিখপ্রতিপক্ষ
দপানিপথের প্রথম যুদ্ধ1526 খ্রিষ্টাব্দের 21 এপ্রিলইব্রাহিম লোদি বনাম বাবর।
খানওয়ার যুদ্ধ1527 সালের 16 মার্চমেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ বনাম বাবর
চান্দেরির যুদ্ধ1528 খ্রিস্টাব্দে 21শে জানুয়ারিমেদিনী রাই বনাম সম্রাট বাবর
ঘাঘরা বা গোগরার যুদ্ধ1529 খ্রিস্টাব্দের 6ই মেমামুদ লোদি, নসরৎ শাহ বনাম বাবর
সম্রাট বাবরের আমলে ঐতিহাসিক যুদ্ধ বিজয়

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (1526)

1526 খ্রিষ্টাব্দের 21 এপ্রিল, লোদি সাম্রাজ্যের ইব্রাহিম লোদি এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের মধ্যে হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ গ্রামের নিকটে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই যুদ্ধক্ষেত্রে (পানিপথের প্রথম যুদ্ধ) কামানের ব্যবহার শুরু হয়।

21শে এপ্রিল সকাল 9টায় প্রায় 15 হাজার মোঘল সৈনিক এবং 20 থেকে 24 টি ফিল্ড আর্টিলারি নিয়ে পানিপথের প্রান্তে হাজির হয়। অপরদিকে, দিল্লির সুলতান ইবরাহিম লোদির বাহিনীতে সর্বমোট লোকসংখ্যা ছিল প্রায় 1,00,000। এর পাশাপাশি হাতি ছিল প্রায় 1,000 এর মত।

এই যুদ্ধে বাবরের শক্তিশালী বন্দুক ও গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে লোদির বিশাল সৈন পরাস্ত হয়। ফলে ইবরাহিম লোদি পরাজিত ও নিহত হন। পতন ঘটে দীর্ঘ 320 বছরের (1206-1526) সুলতানী শাসনের। এরপর সম্রাট বাবর দিল্লী ও আগ্রা দখল করেন এবং “বাদশা” উপাধি গ্রহণ করেন।

এই যুদ্ধে গোয়ালিয়োরের রাজা বিক্রমজিতেরও মৃত্যু হয়। হুমায়ুন বিক্রমজিতের কাছ থেকে বহু মূল্যবান কোহিনূর হীরেটি কেড়ে নিয়ে পিতা বাবরকে উপহার দেন।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর কোন্‌ যুদ্ধ কৌশলের ব্যবহার করেছিলেন?

বাবর এই যুদ্ধে “তুলুগুমা ও আরাবা” নামক নতুন কৌশল ব্যবহার করেন। “তুলুগুমা” দ্বারা বোঝায় সমগ্র সেনাবাহিনীকে বেশ কিছু অংশে বিভক্ত করা যেমন মধ্য, ডান ও বাম পার্শ্ব। ডান ও বাম পার্শ্বভাগ সম্মুখ ও পশ্চাৎ অংশে বিভক্ত করা হয়। এর ফলে ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী প্রতিপক্ষকে সবদিক থেকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধের গুরুত্বঃ

ভারতের ইতিহাসে পানিপথের প্রথম যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধের ফলে ভারতের আদি মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং আধুনিক কালের সূচনা হয়। এই যুদ্ধের ফলে ভারতে 320 বছরের সুলতানী যুগের অবসান ঘটে এবং মোঘল যুগের সূচনা হয়।

খানুয়া’র যুদ্ধ বা খানাবার যুদ্ধ বা খানওয়ার যুদ্ধ (The Battle of Khanwa)

খানওয়া যুদ্ধটি 1527 সালের 16 মার্চ আগ্রা থেকে 60 কিলোমিটার পশ্চিমে রাজস্থানের ভরতপুর জেলার খানওয়া (Khanwa) নামক জেলায় মেবারের রানা সংগ্রামের নেতৃত্বে রাজপুত সৈন এবং বাবরের নেতৃত্বে মুঘোল সৈন পরস্পর মুখোমুখি হয়। এবং যুদ্ধ শুরু হয় 17ই মার্চ।

এই যুদ্ধে ভারতীয় মুসলিক, তুর্কি-আফগানরা রানা সংগ্রাম সিং এর পক্ষ নিয়েছিল। রাজপুত সৈনরা প্রায় 10 ঘন্টা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে বাবরের কামানের বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়। মেওয়ারের মহারাজা রানা সংগ্রাম সিং নিজের পরাজয় দেখে যুদ্ধক্ষেত্রেই আত্মহত্যা করেন। খানুয়ার যুদ্ধে জয়ের পর বাবর ‘গাজী’ উপাধি গ্রহণকরেন।

ভারত ইতিহাসে খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব কী?

ভারত ইতিহাসে খানুয়ার যুদ্ধ অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ডঃ কালীকিঙ্কর দত্ত-র মতে, খানুয়ার যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে সুনিশ্চিতভাবে এক চূড়ান্ত যুদ্ধ—প্রকৃতপক্ষে এর ফলাফল পানিপথের যুদ্ধ অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কারণ- (১) পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাবর ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন মাত্র, কিন্তু খানুয়ার যুদ্ধে মোঘল অধিকার সুদৃঢ় হয় এবং তার সম্প্রসারণের পথ প্রশস্ত হয়। (২) রাজপুত শক্তিজোটের পরাজয়ের ফলে ভারতে রাজপুত প্রাধান্যের আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয় এবং মোগলদের এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়। (৩) খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের ফলে মোগলদের রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু কাবুল থেকে আগ্রায় স্থানান্তরিত হয়। ঐতিহাসিক রাশব্রুক উইলিয়ামস-এর মতে, বাবর যদি খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভ না করতেন তাহলে পানিপথের প্রথম যুদ্ধের জয় নিষ্ফল হত। খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভের ফলেই ভারতে মোগল শাসন এক ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়।

বাবর এর চান্দেরির যুদ্ধ (Babar Chanderi War):

রানা সংগ্রাম সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ও সহযোগী গোয়ালিয়রের চান্দেরি দুর্গের মেদিনী রাই-এর নেতৃত্বে রাজপুতরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। চান্দেরি দুর্গ মধ্যপ্রদেশের গুনার কাছে অশোকনগর জেলায় অবস্থিত। 1528 খ্রিস্টাব্দে 21শে জানুয়ারি বাবর মেদিনী রাইকে পরাজিত করে চান্দেরি দুর্গ ও অন্যান্য কিছু অঞ্চল নিজ অধিকারে আনেন। এরপর, 1528 খ্রিস্টাব্দের 2 রা ফেব্রুয়ারি বাবরের সেনাপতি অযোধ্যা ও লক্ষ্ণৌ জয় করেন।

বাবর এর ঘাগরা যুদ্ধ (Babar Ghagra War):

বাংলা ও বিহারের আফগানদের পক্ষে বাবরকে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি। মৃত ইব্রাহিম লোদির ভ্রাতা মামুদ লোদি-র নেতৃত্বে তারা এক শক্তিজোট গড়ে তোলে। সম্রাট বাবর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন।

এলাহাবাদ, বারাণসী ও গাজিপুর দখল করে তিনি 1529 সালের 2 ফেব্রুয়ারি বাবর তার সেনাবাহিনী নিয়ে বিহার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। 27 ফেব্রুয়ারি তিনি দোয়াব নদী পাড়ি দেন এবং গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থান গ্রহণ করেন।

1529 খ্রিস্টাব্দের 6ই মে পাটনার কাছে গঙ্গা ও গোগরা নদীর সঙ্গমস্থলে সম্মিলিত আফগান শক্তিজোটকে পরাজিত করেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ঘর্ঘরার বা ঘাঘরার বা গোগরার যুদ্ধ নামে খ্যাত।

ঘর্ঘরার বা ঘাঘরার বা গোগরার যুদ্ধের ফলাফলঃ

এই যুদ্ধের ফলে (১) বাবরের এক প্রবল প্রতিপক্ষ শক্তি সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, (২) নব-গঠিত মোগল আধিপত্য সুদৃঢ় হয় এবং (৩) কাবুল থেকে গোগরা এবং হিমালয় থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত ব্যাপক স্থানে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়।

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব

ভারতবর্ষে বাবর মাত্র চার বৎসর রাজত্ব করেন এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে তিন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে তিনি ভারতে একটি নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করে তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করে যান। চার বছরের অধিকাংশ সময়ই তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যাপৃত ছিলেন এবং এই কারণে দেশের মধ্যে নতুন কোনও শাসনতান্ত্রিক, বিচার বিভাগীয় বা রাজস্ব-সংক্রান্ত সংস্কার সাধন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি।

তার রাজ্যের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। জমিদার, জায়গিরদার বা সামন্তপ্রভুরা স্ব স্ব প্রধান ছিলেন—তাদের দমন করা বা কোনও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।

রাশব্রুক উইলিয়ামস মন্তব্য করেন যে, “বাবর তাঁর পুত্রের জন্য যে উত্তরাধিকার রেখে যান তা ছিল দুর্বল, কাঠামোহীন ও মেরুদণ্ডহীন।” এ সত্ত্বেও মোগল সাম্রাজ্যের থপতি হিসেবে ভারত ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কেবলমাত্র দুঃসাহসী রণনিপুণ যোদ্ধা বা সুচতুর কূটকৌশলী হিসেবেই নয়—বিশ্বস্ত বন্ধু, স্নেহময় পিতা, শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতানুরাগী হিসেবেও তিনি স্মরণীয়।

ডঃ স্মিথ-এর মতে, “সমকালীন যুগে সম্রাট বাবর ছিলেন এশিয়ার নৃপতিগণের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিভাসম্পন্ন এবং ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনলাভের অধিকারী।”

বাবরের সাহিত্য প্রতিভার নিদর্শন:

তৈমুরের বংশধরদের মধ্যে বাবরই ছিলেন একজন অত্যন্ত শিক্ষিত অভিজাত মানুষ। সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন তিনি। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে খ্যাত তাঁর রচিত “তুজুক-ই-বাবরী” বা “বাবরনামা” নামে আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ লেখেন। এছাড়া তিনি ‘দেওয়ান’ নামে তুর্কি ভাষায় কবিতার গ্রন্থ লেখেন, ফারসি ভাষায়  ‘মুরাইয়ান’ নামে কাব্য গ্রন্থ লেখেন।

অপরদিকে, তিনি একজন চিত্র শিল্পীও ছিলেন এবং তাঁর হস্তাক্ষর ছিল খুবই সুন্দর। বাবর ‘খাত-ই-বাবরী’ নামে একটি তুর্কী হরফ প্রচলন করেন।

পরবর্তীকালে বাবরের ব্যক্তিগত চরিত্রকে নিয়ে তাঁর খুড়তুতো ভাই মির্জা হায়দার “তারিখ-ই-রশিদি নামে একটি গ্রন্থ লেখেন।

বাবর তার দুই পুত্র হুমায়ুন ও কামরানকে মেদিনী রায়ের দুই কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে রাজপুত নীতির বীজ বপন করে।

মুঘল সম্রাট বাবরের স্থাপত্য শিল্প

সাহিত্যে এবং চিত্র কলার পাশাপাশি বাবর স্থাপত্য শিল্পেরও যথেষ্ট কদর করতেন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধের বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে তিনি হরিয়ানার পানিপথে “কাবুলিবাগ মসজিদ”-নির্মাণ করেন। এছাড়াও নির্মাণ করেন সম্বলপুরে (রোহিলাখণ্ডে) “জাম্মা বা জমি মসজিদ” এবং আগ্রাতে নির্মাণ করেন “লোদী দূর্গ”।

বাবর এর মৃত্যু (Babar Death):

1530 সালের 26 ডিসেম্বর আগ্রায় সাতচল্লিশ বৎসর বয়সে মুঘল সম্রাট বাবর (Babar) এর মৃত্যু হয়। তিনি হিন্দুস্থানে মাত্র চার বছর রাজত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। মৃত্যুর আগে বাবর (Babar) হুমায়ুনকে মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী করেন।

সম্রাট বাবর প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

Students Care

স্টুডেন্টস কেয়ারে সকলকে স্বাগতম! বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার সমস্ত খবরা-খবরের একটি অনলাইন পোর্টাল "স্টুডেন্ট কেয়ার"। পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সমস্ত চাকুরী প্রার্থীদের জন্য, এছাড়াও সকল জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গদের সুবিধার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: স্টুডেন্টস কেয়ার কতৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত !!