ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ এবং ফলাফল ব্যাখ্যা করো।
আজকে ২০১৮ সালের উচ্চমাধ্যমিকে ইতিহাস বিষয়ে আসা বড়ো প্রশ্নের উত্তর গুলি নিয়ে আলোচনা করা হল। আজকের প্রশ্ন হল ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ এবং ফলাফল ব্যাখ্যা করো। উত্তরটি নিচে দেওয়া হল-
ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ এবং ফলাফল
অবশিল্পায়ন কাকে বলে?
অবশিল্পায়ন শব্দটি শিল্পের অধঃপতনকে বোঝায়। শিল্পায়নের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে তাই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রসারে সর্বাপেক্ষা বিষময় ফল হলো ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যমন্ডিত কুটির শিল্পের ধ্বংস। অর্থনৈতিক ইতিহাসের পরিভাষায় এই অবস্থাকে অবশিল্পায়ন বলে।
প্রাক্-শিল্পবিপ্লব পর্যায়ে ভারতবর্ষে হস্ত ও কুটির শিল্পজাতসামগ্রী যথেষ্ট উন্নত ছিল। এইসব পণ্যদ্রব্যের চাহিদাও ছিল সারা ইউরোপ জুড়ে যথেষ্ট। ঢাকাই মসলিন গুণগত মানের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত ছিল।
ডেফো, তাঁর ‘রবিনসন ক্রুশ’ গ্রন্থে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন ‘ইংল্যাণ্ডের ঘরে ঘরে, বসার ঘরে ও শোবার ঘরে সর্বত্র এই ভারতীয় পণ্য সামগ্রী প্রবেশ করেছে।’ কিছু ভারতে কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে দেশীয় শিল্পের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং কালক্রমে তা ধ্বংস হয়ে যায়।
ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ
দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের এই কারণগুলি ছিল—
(১) কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য-
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহার শুরু করে বিনা শুল্কে বাংলার অবাধ বাণিজ্য করতে শুরু করে।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় অন্যান্য কোম্পানিকে হাটিয়ে দিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূলনীতি ছিল সবচেয়ে কম দামে এদেশের কাঁচামাল ক্রয় করে চড়া দামে তা ইউরোপের বাজারে বিক্রয় করা। এর ফলে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
(২) তুলার দাম বৃদ্ধি-
সুতিবস্ত্র তৈরির জন্য যে তুলার প্রয়োজন হয়, কোম্পানির কর্মচারীরা তার উপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করে তা তাঁতিদের চড়া দামে বিক্রয় করত। চড়া দামে তুলো কিনে এবং কম দামে বিক্রি করে তাঁতিরা সর্বস্বান্ত হত।
(৩) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন :
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন দ্বারা ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এক চেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ভারতের বাজারে ইউরোপীয় অন্যান্য বণিকদের অবাধ প্রবেশ ঘটে। ইউরোপে উৎপন্ন অনেক উন্নতমানের সস্তা দামের পণ্যে ভারতের বাজার ভরে যায়।
(৪) শিল্প বিপ্লবের প্রভাব :
অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ড শিল্প বিপ্লব ঘটে যাওয়ার ফলে অতি অল্প সময়ে অতি দ্রুত নানান উন্নত মানের দ্রব্যসামগ্রী উৎপন্ন হতে থাকে।
ইংল্যাণ্ডে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর সাথে প্রতিযোগিতায় ভারতে উৎপন্ন দ্রব্য হেরে যাওয়ায় তা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে— “ইউরোপের পাওয়ার লুমের আবিষ্কার ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসসাধনকে সম্পূর্ণ করেছে”।
(৫) অসম শুল্ক নীতি :
ইংল্যাণ্ডের জিনিসপত্র যাতে ভারতে অবাধে আসতে পারে তার জন্য কোম্পানি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ব্রিটেনে ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়।
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় শতাংশ। মসলিনের উপর শুল্ক ছিল শতাংশ, চিনির উপর শুল্ক ছিল চিনির দামের তিন থেকে চারগুণ। অসম এই শুল্ক নীতির কারণে দেশীয় শিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
(৬) দেশীয় নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব :
পলাশির যুদ্ধের পর ভারতে রাজা, জমিদার সহ অভিজাত শ্রেণির ক্রম অবলুপ্তি ভারতীয় কুটিরশিল্পের উপর চরম আঘাত হানে। কারণ এতদিন পর্যন্ত তারাই ছিল ভারতীয় কুটিরশিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক
(৭) কোম্পানির শোষণ ও তার কর্মচারীদের অত্যাচার :
উইলিয়াম বোল্টস্ তাঁর রচনায় দেখিয়েছেন কীভাবে কোম্পানির কর্মচারী ও দালালরা তাঁতিদের অগ্রীম দাদন নিতে ও ভয় দেখিয়ে শুধুমাত্র ইংরেজ কোম্পানির জন্য সুতিবস্ত্র বুনতে বাধ্য করত।
দাদন গ্রহণকারী তাঁতিরা লোকসান স্বীকার করেও বাজার থেকে ২০-৪০ শতাংশ কম দামে কোম্পানিকে তাদের বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য করতে বাধ্য থাকত।
এমনকি কোম্পানি কাঁচা তুলোর ব্যবসায় একচেটিয়াভাবে বাজারে দখল করে তাঁতিদের কাছে উচ্চ মূল্যে এই তুলো বিক্রয় করত।
(৮) শিল্প সংরক্ষণ নীতি :
ব্রিটিশ শিল্পপতিদের চাপে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করার জন্য শিল্পক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতি বলবৎ করেন।
এই উদ্দেশ্যে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে, ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে, ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে, ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন আইন পাশ করে ইংল্যান্ড এবং ইংল্যাণ্ডের বাইরে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ভারতের রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টি করে।
ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের ফলাফল
(১) বেকারত্ব :
দেশীয় কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। সরকারের অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে রাম্পা জনজাতি যে বিদ্রোহের সূচনা করে তা রাম্পা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
(২) জমির উপর চাপ বৃদ্ধি :
বেকার শিল্পী ও কারিগররা কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত হলে জমির উপর চাপ বাড়ে। দেশে কৃষিজীবী ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
(৩) কাঁচামাল রপ্তানি :
অবশিল্পায়নের ফলে তারও শুধু এক কাচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে পরিচিত হয়। তুলো, রেশম, নীল সব ইংল্যান্ড বণিকরা সস্তায় ক্রয় করে বিদেশে চালান দিতে থাকে।
(৪) নগরজীবন ধ্বংস-
ভারতের প্রাচীন ও শিল্প সমৃদ্ধ নগর যথা ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, সুরাট, মসুলিপত্তনম, তাঞ্জোর,সপ্তগ্রাম জনবিরল হতে থাকে।
(৫) দারিদ্র সংকট বৃদ্ধি :
শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হলে ভারত এক দারিদ্র দেশে পরিণত হয়। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ভারতে সংকট ডেকে আনে।
দলিতদের আন্দোলনের বিবরণ :
ভারতে হিন্দু সমাজ কাঠামোয় জাতভিত্তিক মানুষে মানুষে কালক্রমে এমন বিভেদ সৃষ্টি করেছিল যে সমাজের কিছু জাতি অধঃপতিত, অদ্ভুত হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। এরাই দলিত নামে পরিগণিত। কোম্পানি আমলে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য এই দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল-
(১) যুক্তপ্রদেশের জৌনপুরের দলিত আন্দোলন :
যুক্তপ্রদেশের জৌনপুর অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম চামার অধ্যুষিত ছিল। তারা ভূমিহীন খেতমজুর বা সামান্য জমি চাষ করে জীবন কাটাত। তাদের সামাজিক অবস্থানও ছিল নীচে। এই দুরবস্থা দূর করার এবং নিজেদের সামাজিক অবস্থান ব্রাহ্মণদের সমপর্যায়ভুক্ত করার জন্য তাদের মধ্যে শিব-নারায়ণ ধর্মমত গড়ে ওঠে। এই মত অনুসারীরা শিব-নারায়ণ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত হন। তারা ব্রাহ্মণদের অনুকরণ করে।
(২) এজহাবা সম্প্রদায়ের আন্দোলন :
দক্ষিণ ভারতের কেরালার এজহাবা সম্প্রদায় ছিল দলিত। তারা শ্রী নারায়ণ গুরুর নেতৃত্ব সমাজে ব্রাহ্মণ্য প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। তারা হিন্দু হলেও তাদের হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না, মন্দিরের চলার পথ দিয়ে চলার অধিকার ছিল না। তারা প্রথম ভাইকম সত্যাগ্রহের মাধ্যমে পথ চলার অধিকার লাভ করে এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অনুকরণ করে নিজেদের সামাজিক অবস্থান উন্নতির চেষ্টা করে।
(৩) নাদার সম্প্রদায়ের অন্দোলন :
দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ুর দক্ষিণে নাদার সম্প্রদায় অনুরূপ আন্দোলন করে। এই সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ব্যবসা বা অন্য কাজ করে আর্থিক ভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠে এবং নিজেদের হীন সামাজিক অবস্থানকে উন্নত করার চেষ্টা করে। এরপর মন্দিরে প্রবেশের (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে) দাবিকে কেন্দ্র করে উঁচু জাতের সঙ্গে দলিতদের দাঙ্গা বাধে।
(৪) দলিত পল্লি সম্প্রদায়ের অন্দোলন :
তামিলনাড়ুর উত্তরে দলিত পল্লি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। খেতমজুর, পশুচারণ ও বিভিন্ন কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। এই সম্প্রদায়ের একটি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সচ্ছলতা লাভ করে নিজেদের বানিয়া ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। তারা ব্রাহ্মণদের অনুকরণ করে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ করে।
(৫) মাহার সম্প্রদায়ের অন্দোলন :
মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায় ছিল দলিত গোষ্ঠী। ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকর এই সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে বাবা ভালংকার নামে একজন প্রাক্তন সেনাকর্মীর নেতৃত্বে মাহাররা জোটবদ্ধ হয়। ভালংকর তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য সেনাবাহিনী ও সরকারি কাজে নিয়োগের দাবি জানায়।
উচ্চমাধ্যমিক ২০১৮ ইতিহাসের অন্যান্য প্রশ্ন ও উত্তর গুলি দেখার জন্য এখানে ক্লিক করো
উচ্চমাধ্যমিকের বিগত বছরের প্রশ্ন ও উত্তর PDF ডাউনলোড করার জন্য এখানে ক্লিক করো।
Source: wbchse.nic.in