ভারতের এই গ্রামের ঘর বাড়িতে নেই কোনো ‘দরজা’ : কেন জেনে নিন
ভারতের মহারাষ্ট্রে ‘শনি শিংনাপুর’(shani shingnapur ) একটি গ্রাম রয়েছে। যদি কোনোদিন আপনার যাওয়ার সৌভাগ্য হয় আপনি দেখতে পাবেন ভারতের এই গ্রামের ঘর বাড়িতে নেই কোনো ‘দরজা’ (A village where houses have no doors, windows )। এমনকি বাড়ির লোকজন বেড়াতে গেলেও ঘরের দুয়ার থাকে খোলা। ভাবলে অবাক লাগবে, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে প্রায় তিনশ বছর ধরে চলছে এই প্রথা। আবার লোকো মুখে এই গ্রামের সম্বন্ধে অনেক উপকথা ও শোনা যায়। এই ঘটনা আর উপকথার রেশ ধরে, এই গ্রামে এখন প্রায় পুণ্যার্থী ও পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। আপনি জানলে অবাক হবে, প্রতিদিন ৪০ হাজার মানুষ আসেন শুধুমাত্র এই ‘শনি শিংনাপুর’ গ্রাম দর্শন করার জন্য। আর এই জন-সমাগম গ্রামকে তার চিরাচরিত রূপ থেকে পালটে একটি শহরের আদল দিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় লোকজন দরজা হীন ঘরবাড়ির জন্য কখনো উদ্বিগ্ন হয়না, নিরাপত্তার অভাব বোধ করেনা। এককথায় বলাই যায় No crime here: The Indian village with no front doors or locks।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শনি শিংনাপুরের (shani shingnapur) রক্ষক দেবতা হলেন হিন্দু ধর্মের অন্যতম দেবতা ‘শনি’। শনিকে অনেকেই অমঙ্গলের দেবতা মনে করলেও গ্রাম বাসীরা কিন্তু তা ভাবেনা না, গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এই দেবতাই তাদের অভিভাবক, রক্ষাকর্তা।
আরও পড়ুন- উষ্ণ সাহারাতে তুষারপাত এক বিরল ঘটনার সাক্ষী
এত ক্ষন শুধু পড়লেন এই গ্রামের ঘর-বাড়িতে কোনো দরজা নেই, কিন্তু কেন নেই? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে যে তথ্য মেলে সেগুলো শুনলে কোনো রূপ কথা বা কল্প কথা বা বলতে পারেন উপকথা মনে হলেও হতে পারে। কিন্তু এই গ্রামের অধিবাসীরা ওই কল্প কথা কেই বিশ্বাস করে আসছে কয়েক শ বছর ধরে। ধরেই নিলাম গ্রাম বাসিরা যেটা শুনে বিশ্বাস করে এসেছে সেটা কুসংস্কার, কিন্তু এটাও ঠিক যে ওই গ্রামের বাড়িতে কোনো দরজা না থাকা শর্তেও কোনো সমস্যা হয় না ওখান কার অধিবাসীদের। কিন্তু প্রশ্ন হল কি সেই কাহিনী যার ফলে গ্রাম বাসিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের কোনো ঘর-বাড়িতে দরজা রাখবেন না?
আরও পড়ুন- ভারতের প্রথম উচ্চ গতি সম্পন্ন ট্রেন : বুলেট ট্রেন
জনশ্রুতি বা উপকথা হলো প্রায় তিনশ বছর আগে ভারী বর্ষণের পর প্রবল বন্যা দেখা দেয়। বৃষ্টি-বন্যা চলে যাওয়ার পর ‘পানশনলা’ নদীর তীরে একটি কালো পাথর পড়ে থাকতে দেখা যায়। জল বি-ধৌত এই পাথরের উচ্চতা প্রায় দেড় মিটার হবে। গ্রামবাসী এই পাথরে লাঠির আঘাত করলে দেখা যায় পাথর থেকে রক্ত ঝরছে। ঠিক তার পরের রাতে গ্রাম প্রধানের স্বপ্নে দেখা দেন ‘শনি’ দেবতা। দেবতা গ্রাম প্রধান কে বলেন, ওই কালো পাথরটি তারই প্রতিমুর্তি।

এর পর দেবতা আদেশ দেন তার মূর্তি স্থাপন করতে হবে গ্রামের কোনো একটি চিহ্নিত জায়গাতে। গ্রাম প্রধান শর্ত দেন, তারা দেবতার আদেশ মানবেন কিন্তু তিনি যখন থাকবেন না দেবতা যেন তার গ্রামবাসীকে রক্ষা করেন। অতঃপর, শনি দেবতা খুশি হয়ে তাকে বর দেন তিনি গ্রামবাসীকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন।
এর পর ওই গ্রামের মাঝখানে উন্মুক্ত বেদীতে অধিষ্ঠান করা হয় শনি দেবতাকে। এবং গ্রামের অধিবাসিরা খুলে ফেলে তাদের ঘর-বাড়ির দরজা। এর পর তিনশ বছর কেটে গিয়েছে, পার হয়েছে কয়েক প্রজন্ম। কিন্তু ওই গ্রামের ঘরবাড়িতে আর দরজা লাগেনি। শুধুমাত্র কুকুর বেড়াল দের আটকানোর জন্য কেউ কেউ খোলা দরজার সামনে একটি করে পাতলা কাঠ রেখে দেয়। তাদের মনে প্রানে বিশ্বাস রয়েছে শনি দেবতা তাদের রক্ষা করছেন।এমন কি বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় গ্রামবাসী তাদের টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি সব কিছু বাড়িতেই রেখে যান। কেবল একটি পর্দা ঝুলিয়ে যান, যাতে অন্য রা বুঝতে পারেন যে বাড়িতে কেউ নেই।

আজ তিনশ বছর পর গ্রাম আস্তে আস্তে শহরের রূপ নিচ্ছে। চলছে নির্মাণ কাজ ও। নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গুলোও ওই গ্রামের ঐতিহ্যকে সম্মান করেই নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করছে।
আরও পড়ুন- জানা অজানা বিশ্বের কথা
আর ও একটি বিষয় জানলে অবাক হবেন, এখানে ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত ছিল না কোন পুলিশ স্টেশন। যদি ও বর্তমানে থানা রয়েছে, কিন্তু চালু হ্ওয়ার পর এখনো কোন বড় ধরনের অভিযোগ দায়ের হয়নি। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (UCO Bank) চালু করেছে তাদের প্রথম ‘তালাহীন’ শাখা।

ব্যাংক এর এই শাখাটি কাজ করে চলেছে ২০১১ সাল থেকে। তবে এই ব্যাঙ্কে একটি দরজা আছে, কিন্তু সেটি আবার কাঁচের তৈরি। এবং কেবলমাত্র গ্রামবাসীর বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে, চোখের আড়ালে একটি ‘ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক’ তালা স্থাপন করা হয়েছে শুধুমাত্র নৈশ নিরাপত্তার নিয়মের কারণে।
এমন কি গ্রামবাসী রা নিরাপত্তা সম্পর্কে এত টাই নিশ্চিত যে, কোনো কারনে বাড়ির বাইরে গেলে তারা প্রতিবেশীকেও তাদের বাড়ির দিকে খেয়াল রাখতে বলে যায় না। তাদের অটুট বিশ্বাস, কেউ চুরি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিচার হবে, এবং যার ফল স্বরূপ সে অন্ধ হয়ে যাবে। এক গ্রামবাসী মতানুসারে, কেউ একজন তার বাড়িতে কাঠের দরজা লাগিয়ে ছিলেন। পরে জানা যায় তিনি নাকি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান। আর কেউ অসৎ হলে সে পরের সাড়ে সাত বছরের জন্য দুর্গতিতে পড়েন। এটাই হলো শনি শিংনাপুরকে ঘিরে আবর্তিত হ্ওয়া জনশ্রুতি বা উপকথা। শিংনাপুরে এখন সারা ভারত থেকে প্রতিদিন ৪০ হাজার পূনার্থী ও পর্যটক আসে। বর্তমানে এখানকার শনি মন্দির এখন অন্যতম বিখ্যাত ও ‘বিত্ত শালী মন্দির’।
কিন্তু সংশয়বাদীরা বলেন, এ গ্রামে অপরাধ কম কারণ গ্রামটি একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায়, এক সরল সামাজিক পরিবেশে তাদের অবস্থান, সেই কারণে। কোনো শনি দেবতার আশীর্বাদে নয়। সত্য যাই হোক, কেউ কেউ আবার এখন এই প্রাচীন প্রথার বিরোধীতা করছেন। এবং গ্রামে পঞ্চায়েত গড়ার অনুমতি ও চাইছেন তারা। তারা তালা ও দরজা লাগানোর অনুমতিও চাইছেন। তবে যারা চাইছেন তারা সংখ্যায় খুবই কম। বেশীরভাগ গ্রামবাসী মনে করে, তাদের ঐতিহ্য অব্যাহত থাকবে চিরকাল।
তথ্যসূত্র-
- দ্য হিন্দু
- বি বি সি নিউজ
- ইন্ডিয়া টুডে
আপনাদের মধ্যে যদি কেউ লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকেন, লেখা লেখি করতে ভাল বাসেন তাহলে আপনার মূল্যবান লেখাটি আমাদের মাধ্যমে সকলের সাথে শেয়ার করে নিতে পারেন। লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের নীতিমালা পড়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন।
‘স্টুডেন্টস কেয়ার’ এর সকল লেখার স্বত্ব ব্লগ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংরক্ষিত। লেখক বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যাতিত কোন লেখা অন্য কোন অনলাইন বা অফলাইন মিডিয়াতে প্রকাশিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।