ছয় ঘন্টার জীবন্ত দ্বীপ ‘ বিচিত্রপুর ’ || সাপ্তাহিক অবসরে ঘুরে আসতেই পারেন!
বিচিত্রপুর
সপ্তাহান্তে ছোটখাটো ট্রিপে যেতে চান? দিঘার নিকটেই ওড়িশার সুবর্ণরেখার মোহনায় ম্যানগ্রোভ অরণ্য, লাল কাঁকড়া, বুনো ফুলের গন্ধ নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে ছয় ঘন্টার জীবন্ত দ্বীপ বিচিত্রপুর ।
লিখেছেন- দেবাশীষ দাসমহাপাত্র (শিক্ষক, এগরা এস. এস. বি কলেজ, এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর)

ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির কাছে সমুদ্র মানেই দিঘা। এবার ভ্রমণ মানচিত্রে একটা নতুন জায়গা যোগ করা যেতে পারে। বিক্ষিপ্ত মনটা যদি ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় সমুদ্র তটে, পাড়ি দিন দিঘার থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার অন্তর্গত বিচিত্রপুরে । দিঘার নামের সঙ্গে প্রবলভাবে জড়িয়ে থাকা এক শাসমূল-ঠেসমূলের সাম্রাজ্য। সুবর্ণরেখার গা ঘেঁষে বেরিয়ে আসা চেহারায় সুন্দরবনের রূপ চুরি করে বেড়ে উঠেছে সেই বিচিত্রপুরের ম্যানগ্রোভ বিচ। বিচিত্রপুর নামেই সাফল্য। উদ্ভিদ, প্রাণীকূলের বৈচিত্রে এ অরণ্য ওড়িশার অরণ্য দফতরের একবুক অক্সিজেন মেশানো খণ্ড।সমুদ্র আর ম্যানগ্রোভের গভীর প্রেমে জায়গাটি সত্যি ভিন্নভাবে মনোরম। ম্যানগ্রোভকে নিয়ে নূতন আলাপআলোচনা, সংরক্ষণের প্রয়াস আশার আলো জাগায়। সরকারের এই সাধু প্রচেষ্টা থেকেই জনগণ এই অঞ্চল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে।

শহরের ব্যাস্ততা কে দূরে সরিয়ে নির্জনতাকে যদি সঙ্গী করতে মন চায়, তাহলে ১-২ দিনের জন্য ঘুরে আসুন বিচিত্রপুর ও আশেপাশের এলাকায়। বিচিত্রপুরে নির্জনতা ,নীরবতা নিরালা মিলেমিশে ঘিরে এক অমোঘ শান্তির পরিবেশ তৈরি করেছে। সাগরে ডুব দিলে আপনার শরীর ও মনের ক্লান্তি এক নিমেষেই উধাও হয়ে যাবে । এখানে এসে নৌবিহারের রোমাঞ্চ নিতে ভুলবেন না। সুবর্ণরেখা মোহময়ী আর তার সাথে রয়েছে সুমুদ্রের জ্বলোচ্ছাস। একদিকে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সোঁদা গন্ধ অন্যদিকে আকাশ বাতাস মাত করা কত নাম না জানা পাখির কলরব । সমুদ্রের জলের আওয়াজ আপনার মনকে ব্যাকুল করে তুলবে।
⇒ কিভাবে যাবেন
ট্রেনে ওড়িশার জলেশ্বর স্টেশন থেকে ৪৮ কিলোমিটার। সড়ক পথে এক ঘণ্টা সময় লাগে। হাওড়া থেকে ট্রেনে দিঘা। তার পরে সড়ক পথে ১৪-১৫ কিমি। তাজপুর থেকে সড়ক পথে যেতে হলে দূরত্ব মোটামুটি ২০ কিলোমিটার। তালসারি হয়েও যেতে পারেন। দিঘা থেকে বিচিত্রপুর যেতে ৩০ মিনিট মত সময় লাগে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য অটো বা মোটর ভ্যান আছে। হাতের নাগালেই পেয়ে যাবেন মোটর ভ্যান বা অটো যা আপনাকে কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে দেবে। বিচিত্রপুরের দিকে যেতে ওল্ড দিঘা থেকে ৬০০ -৭০০ টাকা গাড়ি পিছু নিবে।

দরদাম নিজের দায়িত্বে। সেই পথেই অন্নপূর্ণা, সরস্বতী, বাসন্তী, মনসা দেবীদের নামে পুজোর চাঁদা চাইতে নাছোড় কিছু ছেলেছোকরা মিলবে। চোখে চোখ রেখে তাদের এড়িয়ে গেলে দেদার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনার অপেক্ষায়।বাজেট যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে এই অঞ্চলটিতে ঘুরতে যাওয়া কম রোমাঞ্চকর নয়।
যাওয়ার পথেই দেখা মিলবে এঁকেবেঁকে যাওয়া রূপসী সুবর্ণরেখাকে । এই নদী ঝাড়খন্ড থেকে উৎপন্না হয়ে ঘাটশিলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে ওড়িশার বঙ্গোপসাগরে। চন্দনেশ্বর মন্দিরের গা দিয়ে রাস্তা বরাবর এগিয়ে যেতে হবে৷ পাবেন আঁকাবাঁকা পথ গ্রামের পথ৷ আর তারপরই রোদ আর ছায়ার মিশেলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট৷ শুরু বিচিত্রপুরের বিচিত্র রহস্য৷ এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে পাবেন ওড়িশা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটি টিকিট কাউন্টার৷

৮-১০ সিটের ফাইবার স্পিড বোট ছাড়ে সেখান থেকে৷ ১২০০ টাকা প্রতি ট্রিপ ৷ টিকিট কেটে উঠে পড়ুন সেই বোটে। ফেরার পথে অবশ্যই তালসারিতে নামুন। সেখানে সমুদ্র পর্যটনকে আরও ভাগ করে নিয়েছে স্থানীয় যুবকেরা। সুবর্ণরেখারই আরেক মোহনা বেয়ে লাল কাঁকড়ার বিস্তীর্ণ চোখ জুড়োনো বিচ। জোয়ারকালে নৌকায় সেখানে পৌঁছাতে নেয় ৫০ টাকা। ভাটায় ১০০ টাকা নেয় বাইক।
[জঙ্গল সাফারি করতে চান? ঘুরে আসুন ভারতের এই দশটি জঙ্গলে]
⇒ নৌবিহার
এখানে এসে নৌবিহারের সুযোগ ছাড়বেন না। নৌবিহারে ০৮-১০ জনের বসার ব্যাবস্থা আছে , ভাড়া ১২০০ টাকার মতো । এখানে যাওয়ার সময় সকাল ১০:৩০ থেকে বিকেল ৫:৩০ অবধি। সাঁতার না জানা থাকলে সাবধান কারণ এরা কোনো লাইফ জ্যাকেট দেয়না , তাই জলে ভেসে থাকবার মত জিনিস নিয়েই নৌবিহারে যাবেন। বাচ্চাদেরকে না নিয়ে যাওয়াই ভালো।

প্রায় পঁচিশ-তিরিশ মিনিটের জলপথ পার করে ম্যানগ্রোভের আঁচল বেয়ে জলে ঢেউ তুলে স্পিড বোট আপনাকে এক মোহনার মুখে পাড়ে তুলে দেবে। যার সামনে বিরাট এক চর জেগে। সে পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি নেই। তারই আগে বাঁপাশ বরাবর টানা শ্বাসমূলের দ্বীপ থমকে রয়েছে। সুবর্ণরেখা এখানে সাগরে পড়েছে ভাঙা পাড়, অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশা৷ এটাই বিচিত্রপুর৷ এই দ্বীপে জোয়ারে আসা যায় না দিনে মাত্র ৬ ঘণ্টায় জেগে থাকে এই বিচিত্রপুরের বিচিত্র দ্বীপ৷ তাই তার এত আকর্ষণ৷ নৌবিহারে অবশ্যই জেনে নেবেন জোয়ারের সময় মাঝির কাছেই জেনে নিতে পারেন এ চরাচরের চরিত্র।মূল খণ্ডের সঙ্গেই জেগে থাকে আশপাশে আরও দুই-চার খণ্ড ভূমি। বিনা প্রয়োজনে সেখানে কাক-পক্ষী ছাড়া কারও পা পড়ে না।

⇒ কচ্ছপ আর কাঁকড়ার বিচরণভূমি
জানেন কি বিলুপ্তপ্রায় Olive Ridley কচ্ছপ বিচিত্রপুরের সমুদ্র সৈকতে বাসা বাঁধে ও ডিম্ পাড়ে ? এরা জমায়েত ও মিলিত হয় সুবর্ণরেখা আর সাগরের সঙ্গমস্থলে । বিচিত্রপুরে প্রচুর লাল হলুদ কাঁকড়া পাওয়া যায়। আকৃতিতে এরা যথেষ্ট বড় । সৈকতে হাঁটার সময় চোখে পড়বে তাদের দ্রুত আনাগোনা। লোক দেখলেই তাড়াতাড়ি এরা গর্তে ঢুকে যায়। আছে জীববৈচিত্রের অপূর্ব সমাহার।

কুমীর, কুমোট, ঘড়িয়াল তো আছেই। আছে ফ্লেমিংগো, বাঁশপাতি, অদেখা পায়রা, রাজহাঁস-পাতিহাঁস, কাদাখোঁচা, গাংচিলের মতো হরেক রকমের পরিযায়ী।
[পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি রাজবাড়ীর অতীতের অজানা কাহিনী]
⇒ কোথায় থাকবেন ও কি খাবেন
বিচিত্রপুরে যদিও রাতে থাকার কোনো উপায় নেই – কিছু হোটেল বা লজ না থাকায় । তাই বিকালের পর দীঘা ফিরে আসতে হবে। থাকার জায়গা হিসাবে দিঘা ভালো। ম্যানগ্রোভ অরণ্য , সমুদ্র ,নৌবিহার এখানকার আকর্ষণ। এখানে খুব একটা দোকানপাট নেই ,দু একটা ছোট ছোট দোকান আছে তাতে সামান্য কিছু খাওয়ার পাওয়া যায়।

যদি বাচ্চা সঙ্গে থাকে তাহলে তার খাওয়ার আর ওষুধ আনতে ভুলবেন না যেন। বড়দের জন্য ও কিছু শুকনো খাওয়ার রাখা উচিত। নৌবিহারে যাওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ক্যামেরার উপর জলের ঝাঁপটা না লাগে,ক্যামেরা খারাপ হয়ে যেতে পারে। এখানে কোনো ছায়া ঘেরা জায়গা নেই যেখানে বয়স্ক ও বাচ্চারা রোদ বা বৃষ্টির সময় আশ্রয় নিতে পারে,তাই ব্যাগে সবসময় ছাতা রাখবেন। সবসময় জলনিরোধ জুতা ব্যাবহার করবেন।
⇒ শেষ হয়ে হইলো না শেষ
দিঘা নামটার সাথে আমরা যতটা পরিচিত দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিচিত্রাপুর জায়গাটির সম্পর্কে আমরা ততটা ওয়াকিবহাল নই। সারা বছরই এখানে ফাঁকা থাকে, লোকের সমাগম কম। তার একমাত্র কারণ হলো এই পর্যটন কেন্দ্রকে নিয়ে প্রচার অনেক কম এবং এখানে হোটেল ,রেস্তোরার সংখ্যা গুটিকয়েক। লোক এখানে আসে কম এবং আসলেও ১-২ দিনের বেশি থাকে না।
এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য এবং পর্যটন শিল্পকে ত্বরান্বিত করতে সরকারী এবং বেসরকারী উভয় বিভাগকেই গিয়ে আসতে হবে। দ্বীপে ট্যুরিস্টদের ফেলে যাওয়া প্যাকেট, বোতল, যদিও এখানে মদ্যপান নিষিদ্ধ তবুও আইনের ফাঁক গলে পড়ে আছে এই সব আবর্জনা৷
ভ্রমণ কাহিনী পাঠান এই ই-মেলে- [email protected]
