ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান পর্যালোচনা করো।
আজকে ২০১৮ সালের উচ্চমাধ্যমিকে ইতিহাস বিষয়ে আসা বড়ো প্রশ্নের উত্তর গুলি নিয়ে আলোচনা করা হল। আজকের প্রশ্ন হল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান পর্যালোচনা করো। উত্তরটি নিচে দেওয়া হল-
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান পর্যালোচনা করো।
উঃ ভারতের রাজনীতিতে সুভাষচন্দ্র বসুর আবির্ভাব উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। শিক্ষাগুরু বেণিমাধব দাস, রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু চিত্তরঞ্জন দাস ও সর্বোপরি আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুরু স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণাতেই I. C. S. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেও লোভনীয় চাকুরি ত্যাগ করে দেশমাতার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। ছাত্রাবস্থাতেই সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ বিরোধী মন্ত্রে দীক্ষিত হন এবং জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন,
যে কারণে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় বার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধিপন্থী ব্যক্তিবর্গ তাঁর কাজে চরম অসহযোগিতা করলে তিনি ওই পদ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই ‘ভারত সুরক্ষা আইনে‘ সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করেন। কয়েকমাস পরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে তাঁর বাসভবনে নজরবন্দি করে রাখা হয়।
সেখান থেকে ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জানুয়ারি গৃহত্যাগ করেন। পুলিশের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু গিয়াসউদ্দিনের ছদ্মবেশে কাবুল হয়ে সন্ধ্যেয় মস্কোয় উপস্থিত হন। রুশ প্রধান স্ট্যালিন-এর নিকট থেকে কোনো সাহায্য লাভের প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় তিনি জার্মানির উদ্দেশ্যে রওনা হন।
জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র :
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান হিটলার ও ইতালির রাষ্ট্রপ্রধান মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয় রাষ্ট্রপ্রধান তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বতোভাবে সহয়তাদানের প্রতিশ্রুতি দেন। সুভাষচন্দ্র বসু জার্মান সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায়—
(ক) বার্লিনে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে আজাদ হিন্দুস্থান বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, যার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন নাম্বিয়ার নামে একজন দেশপ্রেমিক। সুভাষচন্দ্র বসু এই বেতার কেন্দ্র থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রচার চালাতে থাকেন।
(খ) জার্মানির হাতে বন্দি ৪০০ ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে ‘স্বাধীনতা ভারতীয় লিজন (Free India Legion ) নামে এক সৈন্যদল গঠন করেন।
এই সেনাদল সুভাষচন্দ্র বসুর দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সর্বপ্রথম তাকে। ‘নেতাজি’ অভিধায় ভূষিত করে এবং ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানায়।
জাপানে সুভাষ বসু :
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন মোহন সিং ও বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আহ্বানে সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের রাজধানী টোকিওতে হাজির হন (১৩ জুন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকী তোজো তাকে সমস্ত রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
এখানে জাপানের হাতে বন্দি প্রায় ৪০,০০০ ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে রাসবিহারী বসু ও ক্যাপ্টেন মোহন সিং যে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেছিলেন তা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন।
সুভষচন্দ্র বসু এই বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে তাদের আত্মত্যাগ, আত্মবিশ্বাস ও ঐক্যের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে কতগুলি বিগ্রেডে বিভক্ত করেন। যেমন-
- (ক) গান্ধি ব্রিগেড
- (খ) আজাদ ব্রিগেড
- (গ) নেহরু ব্রিগেড
- (ঘ) ঝাসি রাণী ত্রিগেড ইত্যাদি।
এই সমস্ত ব্রিগেডে প্রধানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- শাহনওয়াজ খান, গুরুবন্ত সিং ধিলন, প্রেমকুমার সায়গল, ড লক্ষ্মী স্বামীনাথন প্রমুখ।
আজাদ হিন্দ সরকার গঠন :
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে সুভাষ বসুর নেতৃত্বে ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ স্থাপিত হয়। জাপান, জার্মানি, ইটালি, থাইল্যান্ডসহ ন-টি দেশে এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
এই আজাদ হিন্দ সরকার ২৩ অক্টোবর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর সহযোগিতার নিদর্শন স্বরুপ আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তুলে দেন।
নেতাজি ৩১ ডিসেম্বর এই দুটি দ্বীপের নাম রাখেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ। এই সময় নেতাজি দেশবাসীকে মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আবেদন জানিয়ে ঘোষণা করেন “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব (Give me Blood, I shall give you freedom)’।
দিল্লি চলো অভিযান :
নেতাজি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ জানুয়ারি রেঙ্গুনে পৌঁছান এবং সেখানেই তিনি তার বাহিনীর প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। এরপর শুরু হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান। নেতাজি তাঁর বাহিনীকে আহ্বান জানান-“দিল্লি চলো”, “দিল্লির পথ স্বাধীনতার পথ”, “কদম কদম বাঢ়ায়ে যা”।
এরপর আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানের সহযোগিতায় ওই বছরের মার্চ মাসে ভারত সীমান্তে মউডবা ঘাঁটিটি ব্রিটিশদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়। ক্রমে তারা মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল, নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা দখল করে (৬ এপ্রিল ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের সীমানা থেকে প্রায় ১৫০ মাইল অভ্যন্তর পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মসমর্পণ :
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট)।
স্বদেশ রক্ষার জন্য জাপান, ব্রহ্মদেশ থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় ও ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাপান মিত্র শক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জাপানের সহযোগিতা না পাওয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। নেতাজি আরও একবার শক্তি পরীক্ষার আশায় বিমানে উঠলেন। কিন্তু সে আশা দুরাশায় পরিণত হল। প্রচারিত হল তাইহোকু বিমান বন্দরে নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান :
ভারতবাসী নেতাজির হাত ধরে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল। নেতাজির সারা জীবনের আত্মত্যাগ ঋষিতুল্য। যে কারণে ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, “ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অমিত বিক্রম ও শৌর্য ছিল অতুলণীয়।”
- (১) বহু বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও তারা উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ১৫০ বর্গমাইল এলাকাকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিল।
- (২) আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা যুদ্ধে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তাতে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে ভারতে তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
- (৩) আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দেশবাসীর মনে প্রবল জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।
- (৪) আজাদ হিন্দ বাহিনীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্তীকালে ভারতে নৌ-বিদ্রোহ ঘটে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
উচ্চমাধ্যমিক ২০১৮ ইতিহাসের অন্যান্য প্রশ্ন ও উত্তর গুলি দেখার জন্য এখানে ক্লিক করো
উচ্চমাধ্যমিকের বিগত বছরের প্রশ্ন ও উত্তর PDF ডাউনলোড করার জন্য এখানে ক্লিক করো।
Source: wbchse.nic.in