উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো।
আজকে ২০১৮ সালের উচ্চমাধ্যমিকে ইতিহাস বিষয়ে আসা বড়ো প্রশ্নের উত্তর গুলি নিয়ে আলোচনা করা হল। আজকের প্রশ্ন হল উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো। উত্তরটি নিচে দেওয়া হল-
উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা
উঃ উনিশ শতকে ভারতবাসীর দুরবস্থা দূর করার জন্য জাতীয় জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের চেষ্টা হয়। বিস্তার ঘটে পাশ্চাত্য শিক্ষার; গড়ে ওঠে সাহিত্য, প্রকাশিত হয় সংবাদপত্র, সূচনা হয় ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের।
চিত্রকলা বিজ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত প্রসারিত হয়। ফলে ভারতে নবজাগরণের সূচনা ঘটে। যেহেতু বাংলাদেশে এই সমস্ত উপাদানগুলি প্রবল ছিল তাই নবজাগরণের সূচনা বাংলাদেশেই প্রথম হয়।
নবজাগরণের প্রকৃতি-
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে কেউ কেউ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের ইতালীয় নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। তা ছাড়া বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি, সীমাবদ্ধতা, গুরুত্ব প্রভৃতি বিষয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যেমন—
(১) বাস্তব নবজাগরণ-
উনিশ শতকে বাংলায় প্রকৃতই নবজাগরণ ঘটেছিল বলে অনেকেই মনে করেন। বাংলার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জাগরণকে স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর গ্রন্থে দ্বিধাহীনভাবে ‘Renaissance’ বা ‘History of Bengal’ নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বাংলার নবজাগরণকে ইতালির নবজাগরণের চেয়ে ব্যাপক, গভীর ও বৈপ্লবিক বলে উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক সুশোভন সরকার, অম্লান দত্ত প্রমুখ বাংলার নবজাগরণের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেও একে ‘নবজাগরণ’ বলে মেনে নিয়েছেন।
তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজা রামমোহন রায় এক চিঠিতে আলেকজান্ডার ডাফকে লিখেছিলেন- “আমি ভাবতে শুরু করেছি যে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতো কিছু একটা ভারতে ঘটতে চলেছে”।
(২) বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয় :
অনেক ঐতিহাসিক বাংলার নবজাগরণের কথা স্বীকার করলেও অনেকে আবার একে প্রকৃত নবজাগরণ বলতে রাজি নন। যেমন—
(ক) তথাকথিত নবজাগরণ :
প্রখ্যাত পণ্ডিত অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি তৈরির সময় বাংলার উনিশ শতকে নবজাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, এই জাগরণ শহর কলকাতার মানুষের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, গ্রামীণ বাংলার জনগণকে তা স্পর্শ করতে পারেনি।
(খ) ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয় :
গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন, “বাংলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী”। তাঁর মতে আমাদের আধুনিক যুগের লেখকগণ ইউরোপের অনুকরণে সোহাগভরে বাংলার নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনটির নাম দেন ‘নবজাগরণ’।
ইউরোপের নবজাগরণ ছিল সামস্তপ্রথার বিরুদ্ধে কিছু বাংলার নবজাগরণ ছিল জমিদার ও মধসত্ত্বাভোগীদের একত্রিত হয়ে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের আন্দোলন।
(গ) ঐতিহাসিক প্রতারণা :
ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাঁর ‘বাংলার নবজাগৃতি” গ্রন্থে বলেছেন, “উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি মিথ্যাচার”। নবজাগরণকে তিনি একটি ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন।
নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা :
উনিশ শতকে বাংলার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। যথা—
(১) ইতালির ফ্লোরেন্স নগরী ইউরোপের নবজাগরণে যে ভূমিকা পালন করে, বাংলার কলকাতা তা করতে পারেনি। ইতালির ফ্লোরেন্স ছিল স্বাধীন নগরী। অপরদিকে কলকাতা গড়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ঔপনিবেশিক কেন্দ্র হিসেবে।
স্বভাবতই ফ্লোরেন্সের মতো স্বাধীন মানসিকতা ও শিল্পীমন কলকাতার ছিল না।
(২) উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। কৃষক-শ্রমিকসহ সমাজের একটি বড়ো অংশ এই নবজাগরণের শরিক হতে পারেনি।
(৩) বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত বর্ণ-হিন্দুদের, মুসলিম সমাজ এর বাইরে ছিল।
(৪) বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তরা বাংলার সমাজকাঠামো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতে পারেননি।
(৫) বাংলার নবজাগরণ মূলত সমাজের উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই প্রসারিত হয়েছিল। শহরের ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই জন্য ড. অনিক শীল একে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন।
উচ্চমাধ্যমিক ২০১৮ ইতিহাসের অন্যান্য প্রশ্ন ও উত্তর গুলি দেখার জন্য এখানে ক্লিক করো
উচ্চমাধ্যমিকের বিগত বছরের প্রশ্ন ও উত্তর PDF ডাউনলোড করার জন্য এখানে ক্লিক করো।
Source: wbchse.nic.in